গুজরাতে গেরুয়া ঝড়, হিমাচলের আস্থা হাতে

যেমনটা ভাবা গিয়েছিল, অনেকটা সে রকমই। গুজরাতে বিজেপি। হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেস। আর দিল্লি পুরভোটে আম আদমি পার্টি (আপ)। সাম্প্রতিক তিন ভোটে জয়তিলক আঁকা হল তিন দলের কপালে।

তবে সব কিছু সম্ভবত মিললও না। যেমন, টানা ২৭ বছর ক্ষমতায় থাকা দলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, বাধ্য হয়ে একের পর এক মুখ্যমন্ত্রী বদল, ভোটের মুখে মোরবীতে সেতু বিপর্যয়— এত ধাক্কা সামলে গুজরাতে বিজেপির এতখানি একতরফা জয়, এমন প্রবল গেরুয়া ঝড় সম্ভবত আঁচ করতে পারেননি দলের বহু সমর্থকও। হিমাচলে এমনিতেই প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের রেওয়াজ রয়েছে। তার উপরে সেখানে যথেষ্ট নড়বড়ে অবস্থায় ছিল বিজেপি। প্রশ্ন উঠেছে, সেই সুযোগে কি জয় আরও জোরালো হওয়ার কথা ছিল না কংগ্রেসের? টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে দিল্লি পুরনিগমে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হলেও, সেখানে জোর টক্কর হয়েছে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ-এর সঙ্গে।

তা হলে সব মিলিয়ে, দেশের রাজনীতির জন্য কী কী বার্তা দিয়ে গেল এই তিন নির্বাচনের ফলাফল? ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে কী পাঠ পড়া যেতে পারে এই তিন ব্যালট যুদ্ধের ফল থেকে? একে একে তা বরং একটু  সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া যাক—

এক, মসনদে টানা ২৭ বছর থাকার পরেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজ্য গুজরাতে বিজেপি এখনও কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থনীতির ভাষায়, সেখানে যেন রাজনীতির একচেটিয়া কারবারি তারা। বাকিদের দূরবীনেও খুঁজে পাওয়া দায়।

দুই, মহাত্মা গান্ধীর রাজ্যে এই নিয়ে টানা সাত বার ক্ষমতায় ফিরছে মোদী-শাহের দল। তা-ও রেকর্ড গড়ে! এর আগে ১৯৮৫ সালে কংগ্রেসের মাধব সিংহ সোলাঙ্কি সরকার গড়েছিলেন ১৪৯টি আসনে জিতে। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও শেষ দফার গণনা চলছে। তাই চূড়ান্ত ফল হাতে না এলেও এটুকু স্পষ্ট যে, সেই রেকর্ড এ বার ছাপিয়ে যাবে বিজেপি।

তিন, বহু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আপ গুজরাতে লড়েছে। সেখানে পাওয়া ভোটের দৌলতে জাতীয় দলের তকমাও পেয়ে যাবে তারা। কিন্তু তেমনই সেখানে তারা এবং ওয়েইসির দল কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসানোয় সুবিধা হয়েছে বিজেপিরই।  

চার, ২০১৭ সালের ভোটে গুজরাতে ৯৯টি আসন দখল করে ‘কষ্টে’ জিতেছিল বিজেপি। সে কথা মনে রেখেই সম্ভবত ২০২৪ সালের ভোটের আগে এই রাজ্যে গদি ধরে রাখতে ‘জান কবুল’ করেছিলেন মোদী। তিনি জানতেন, কোনও কারণে, তাঁর নিজের রাজ্যে বিজেপির পা পিছলে গেলে, তা লোকসভা ভোটের আগে বিপুল মনোবল জোগাবে বিরোধী শিবিরকে। গান্ধীনগরের গদি ধরে রাখতে তিনি কতখানি একবগ্গা ছিলেন, একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। এ রাজ্যে ভোট প্রচারে অন্তত ৩০টি র‌্যালি করেছেন মোদী। সেখানে রাহুল গান্ধী মোটে দু’টি!

পাঁচ, পরিশ্রমের ফসল নিজের-নিজের মতো করে ঘরে তুলেছে দুই দল। ২০১৭ থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে কংগ্রেসের ভোট ৪১% থেকে কমে হয়েছে প্রায় ২৭%। সেখানে বিজেপির ভোট ৪৯% থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৩%।

ছয়, ১০ শতাংশেরও কম মুসলিম থাকা গুজরাতে সাম্প্রদায়িক প্রচার যে ভোট-বাক্সে কতখানি ডিভিডেন্ড দিতে পারে, তারও সম্ভবত নমুনা হয়ে থাকল এই ফল। অমিত শাহ প্রকাশ্যে ‘ওদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে’ বলেছেন। ভোটের মুখে ছাড়া পেয়েছে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীরা। এবং দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, মদ, মাদক, বেকারত্ব, মোরবী-কাণ্ড সমস্ত কিছুকে পিছনে ফেলে মসৃণ জয় তুলে নিয়েছে বিজেপি। এর পিছনে ওই সাম্প্রদায়িক প্রচারের ভূমিকাকে একেবারেই ফেলে দেওয়া চলে না। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি দুর্নীতির অভিযোগ, প্রশাসনের অস্বচ্ছতা, বেকারত্ব এগুলো ভোট-সিদ্ধান্তে  বিবেচ্য বিষয়ই হল না? সবই কি ধুয়ে গেল সাম্প্রদায়িকতায়?

সাত, মোদী-শাহের ভোট জেতার উদগ্র ইচ্ছের সঙ্গে টক্কর দেওয়া তো দূর, গুজরাতে যেন নির্বাচনের আগেই হেরে বসে রইল কংগ্রেস। রাহুল প্রচারে গেলেন মোটে দু’বার। গত বার কংগ্রেসের ৭৭ জন বিধায়কের মধ্যে প্রায় ২০ জন পরে শিবির বদল করে ঢুকে গিয়েছিলেন বিজেপির দিকে। তবে কি জেতার পরেও বিধায়ক হাতছাড়া হওয়ার হতাশা লড়াই আরও ফিকে করে দিল কংগ্রেসের?

আট, গুজরাত এবং হিমাচলে দু’রকম ফলের পিছনে বড় ভূমিকা রইল বিজেপির বিক্ষুব্ধদেরও। টিকিট না পেয়ে গুজরাতে যাঁরা ক্ষুব্ধ ছিলেন, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন চুপচাপ। সেখানে হিমাচলে তা নিয়ে হাঙ্গামা হয়েছে রীতিমতো। পাহাড়ের কোলের ওই রাজ্যে বিক্ষুব্ধরা কয়েক জন জিতেওছেন। এই রাজ্যে জয় কংগ্রেসকে সামান্য হলেও অক্সিজেন জোগাবে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, গুজরাত যদি মোদী-শাহের রাজ্য হয়, হিমাচলও তা হলে বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডার রাজ্য। তাই সেখানে বিজেপির এই পরাজয় তাঁর ব্যক্তিগত হারও।

তা হলে সব মিলিয়ে গল্পটা কী দাঁড়াল? এই তিন জায়গার ফল কি ২০২৪-এ বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত?

কোনও সন্দেহ নেই যে, এই তিন ফল যথেষ্ট উৎসাহ জোগাবে বিজেপিকে। একে গুজরাতে রেকর্ড জয়, তার উপরে বাকি দু’জায়গাতেও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে কড়া লড়াই দিতে পারা। সব মিলিয়ে, এই ফল পদ্মকে চাঙ্গা করবেই। কিন্তু তেমনই বিরোধীদের জন্যও আশার কথা দু’টি।

প্রথমত, তিন ফলে স্পষ্ট, বিরোধী শিবির একজোট হয়ে লড়লে, বিজেপিকে রোখা সম্ভব। যেমন উত্তরপ্রদেশে মইনপুরী উপনির্বাচনে কংগ্রেস, বিএসপি প্রার্থী না দেওয়ায় লড়াই হয়েছে বিজেপি বনাম এসপি-র। সেখানে সহজেই জিতেছেন মুলায়ম সিংহ যাদবের পুত্রবধূ, অখিলেশ-পত্নী ডিম্পল যাদব। এ কথা ঠিক যে, মইনপুরী এসপি-র খাসতালুক। কিন্তু আর এক ডাকাবুকো এসপি নেতা আজ়ম খানের গড় রামপুর-সদরে কিন্তু জয়ের পথে বিজেপি। লড়াই সেখানে বহুমুখী।

দিল্লি পুরভোটে আসন সমঝোতা না হলেও তলে-তলে বহু আসনে কংগ্রেসের সঙ্গে স্থানীয় স্তরে বোঝাপড়া হয়েছিল আপ-এর। রাজধানীর পুরনিগমে টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা বিজেপিকে সরিয়ে ২৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩৪টি জিতে ক্ষমতা দখল করেছে কেজরীওয়ালের দল।

কোথাও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা প্রভাব ফেলেছে (হিমাচল), কোথাও তা চোখেই পড়েনি (গুজরাত)। তাই এই তিন ভোট চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, ২০২৪-এ মোদী-শাহকে বেগ দিতে হলে, আগে নিজেদের হাত মেলানো জরুরি। সংসদে সবে শুরু হওয়া শীতকালীন অধিবেশনের আগে কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের ডাকা  বিরোধী দলগুলির বৈঠকে গিয়েছিল তৃণমূল, আপ-এর প্রতিনিধি। বহুদিন পরে। তার মানেই এই নয় যে, বিরোধী জোট দানা বাঁধছে। বরং এখনও তার উল্টো লক্ষণই চোখে পড়েছে বেশি। কিন্তু তবু প্রশ্ন, এর পরে তবে কি অন্তত জোট বাঁধার প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করবেন বিরোধীরা?  

হাতে টাকার জোগান, কর্মীর সংখ্যা, ভোটে লড়ার পরিকাঠামো— সব কিছুতেই এই মুহূর্তে বিজেপি বাকি সব দলের থেকে বহু যোজন এগিয়ে। তবু যে জোট বাঁধলে তাদের হারানো যায়, এই বার্তাও কিন্তু দিয়ে গেল এই তিন ভোটের ফল।

Featured Book: As Author
The Real Face of Facebook in India
How Social Media Have Become a Weapon and Dissemninator of Disinformation and Falsehood
  • Authorship: Cyril Sam and Paranjoy Guha Thakurta
  • Publisher: Paranjoy Guha Thakurta
  • 214 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon
 
Featured Book: As Publisher
Chasing His Father's Dreams
Inside Story of Odisha's Longest Serving Chief Minister