ভারত জোড়ো যাত্রায় কংগ্রেসের লাভ কতটা?

৩০ জানুয়ারি, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর মৃত্যুদিনে শ্রীনগরে শেষ হল কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা। পদব্রজে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পৌঁছতে রাহুল গান্ধীর লেগেছে ১৩৫ দিন। প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০ কিলোমিটার হেঁটেছেন তিনি। প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ রাহুল অতিক্রম করেছেন ১৩টি রাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে।

চলতি বছরে কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যওয়াড়ি নির্বাচনে পরিমাপ করা যাবে না ভারত জোড়ো যাত্রার ফসল কতটা ঘরে তুলতে পেরেছে কংগ্রেস। সেটা বোঝা যাবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে। কারণ, অতীতে দেখা গিয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়ে ভাল ফল করেনি কংগ্রেস। কিন্তু ওই লোকসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগেই ওই তিন রাজ্যে সরকার গঠন করেছিল রাহুলের দল।

লোকসভা নির্বাচন হতে এখনও এক বছরের একটু বেশি সময় বাকি। তার আগেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলিকে ঘিরে নির্বাচন হলে বিপাকে পড়তে হবে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের। ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল বারবার সরব হয়েছেন— বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, দেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে বেড়ে চলা আর্থিক বৈষম্য নিয়ে। যা দেশের যুব সমাজের কাছে জ্বলন্ত বিষয়। ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে রাহুল বারবার বলেছেন, ‘‘এটা কোনও রাজনৈতিক যাত্রা নয়। বিজেপি-আরএসএস দেশটাকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটাতে চাইছে। আমরা চাইছি ভারতকে জুড়তে। তাই এই ‘ভারত জোড়ো’।’’

কন্যাকুমারী থেকে রাজীব-পুত্র যখন যাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন অনেকেই ভাবতে পারেননি এত মানুষ তাঁর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটবেন। কে নেই সেই যাত্রায়— আট থেকে আশি সকলেই আছেন। চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি ছিল অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। এক কথায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিয়েছেন ভারত জোড়ো যাত্রায়।

এই কর্মসূচি নিয়ে প্রথমে তাচ্ছিল্য করলেও, বিজেপি নেতারা ক্রমশ বুঝতে পেরেছেন দেশবাসীর মধ্যে রাহুলের একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে। আর সেই জনপ্রিয়তাকে আঘাত করতেই বারবার ভুয়ো খবর, মিথ্যে খবর প্রচার করা হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে রাহুলের ছবিও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বোন প্রিয়ঙ্কার সন্তানদের সঙ্গে রাহুল খেলছেন সেই পুরনো ছবিকে প্রচারের অস্ত্র করেছিল বিজেপি। রটানো হয়েছিল, ভারত জোড়ো যাত্রায় লোক নেই, রাহুল বসে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছেন। শুধু তাই নয়, কন্যাকুমারী থেকে যখন রাহুল যাত্রা শুরু করলেন, তখন গৈরিক শিবির থেকে বলা হল, স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তিতে সনিয়া-তনয় শ্রদ্ধা জানাননি। যা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। কুৎসা এখানেই শেষ নয়, রাহুলের জুতো, টি-শার্টের দাম নিয়ে বার বার প্রচার করা হয়েছে। কম ব্যঙ্গ হজম করতে হয়নি কংগ্রেসের এই প্রাক্তন সভাপতিকে। অপপ্রচার-ব্যঙ্গ সব কিছুকে হেলায় উড়িয়ে নিজের লক্ষ্য স্থির থেকেছেন রাহুল। প্রবল ঠান্ডায় অন্যেরা যখন কাঁপছেন, তিনি তখন একটা হাফ হাতা টি-শার্ট পড়ে হেঁটেছেন, যা বহু মানুষকে অবাক করেছেন। ওই টি-শার্ট তিনি ছাড়লেন শ্রীনগরে তুষারপাতে। সেখানে দেখা গেল ফেরান পরিহিত রাহুলকে।

পোশাক নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, কিন্তু তেমন ভাবে বলা হচ্ছে না এই দীর্ঘ যাত্রাপথে রাহুল অনেকবার সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। শুধু সাংবাদিক কেন, সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন। যে যা খুশি প্রশ্ন করেছেন, তা তিনি ধৈর্য্য ধরে শুনেছেন এবং উত্তর দিয়েছেন। এমনকি, তিনি কেন বিয়ে করছেন না কেন— সেই প্রশ্নও হাসিমুখে শুনেছেন রাহুল।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। ব্যতিক্রম ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এক বার সাংবাদিক বৈঠক। সেখানে পুরো সময়টাই তিনি নীরবই ছিলেন। ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। বেছে বেছে কিছু সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মাত্র। অভিনেতা অক্ষয় কুমারকেও তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ওই সাক্ষাৎকারে অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি আম কী ভাবে খান?’’ এখানেই রাহুল একটি ফারাক গড়ে দিয়েছেন মোদীর সঙ্গে। রাজনীতি, কংগ্রেসের দুর্বলতা, ব্যক্তিগত জীবন, আপনার দলের মুখ্যমন্ত্রীরা বড় বড় শিল্পপতিদের পাশে বসে আছেন আর আপনি সেই শিল্পপতিদের সমালোচনা করছেন — সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন রাহুল। সেই জবাব সকলের পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু তিনি উত্তর দিয়েছেন। এটাই মোদীর সঙ্গে তাঁর বৈপরীত্য।

ভারতের রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী একটা জিনিস করতে সফল হয়েছেন, তা হল ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি। সেই জন্যই তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমি..আমি ছাড়া কে! রাহুল গান্ধী, সে তো পাপ্প…!’’ পাপ্পু মানে কী? মানে, যে কিছুই করতে পারে না। এই ছবিটাই রাহুল সম্পর্কে তৈরি করতে চেয়েছিল বিজেপি। তাঁর ‘পাপ্পু ভাবমূর্তি’ ভাঙার চেষ্টা ভারত জোড়ো যাত্রার মাধ্যমে করতে চেয়েছেন ওয়েনাডের এই কংগ্রেস সাংসদ।

বিজেপি নেতারা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন অনেকগুলি রাজ্যে দল দুর্বল হয়ে পড়েছে। যেমন, বিহার, কর্নাটকে। তাই মোদীকে বলতে হচ্ছে, ‘আমাদের মুসলিমদের কাছে যেতে হবে’, ‘অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করবেন না’। ১৬০টি লোকসভা কেন্দ্রকে বিজেপি বেছে নিয়েছে, যেখানে তারা দুর্বল। লোকসভা নির্বাচনের রণকৌশল তৈরিতে এখন পুরোদমে ব্যস্ত বিজেপি।

অতীতে বহু বার দুর্বল হয়েছে কংগ্রেস, আবার শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০০৯ থেকে কংগ্রেসের যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে তা এখনও চলছে। এই দলটি কী ভবিষ্যতে আরও দুর্বল হবে? উত্তর হয়তো আগামী দিনে মিলবে। কিন্তু আমার মতে, ভারত জো়ড়ো যাত্রা কংগ্রেসের রক্তক্ষরণ রোধ করবে।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি রাহুলকে নিয়ে এখন চিন্তিত বিজেপি। দক্ষিণ থেকে উত্তরে তাঁর যাত্রা বিজেপি নেতৃত্বের শিরঃপীড়া বাড়িয়েছে। কিছুটা হলেও ঘাবড়ে গিয়েছেন তাঁরা। এখানে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ না করে পারছি না। ৭ জানুয়ারি পঞ্জাবে যাচ্ছিলাম। হরিয়ানায় কারনালের কাছে দেখি ভারত জোড়ো যাত্রা চলছে। ‘রাফাল দুর্নীতি’ নিয়ে একটা বইয়ের সহলেখক আমি। সেটা নিয়ে রাহুলের সঙ্গে দেখা করলাম, উপহার হিসেবে বইটা দিলাম। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। ওঁর সম্মতি নিয়ে একটা ছবিও তুললাম। ওই ছবিতে রাহুলের সামনে একটা গ্লাসে চা আর পাত্রে বিভিন্ন ধরনের বাদাম রাখা ছিল। সেই ছবিটা আমি টুইটারে পোস্ট করেছিলাম। তার কয়েক ঘণ্টা পরে আমার অবাক হওয়ার পালা। দেখলাম, ওই ছবিটাকে ডাউনলোড করে ফোটোশপের মাধ্যমে চায়ের জায়গায় মদের গ্লাস এবং বাদামের জায়গায় মুরগির কাবাব দেখানো হয়েছে। মনে হয়, গোটা কাণ্ডটা করেছে বিজেপি-র ওই আইটি সেল। এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট রাহুল কতটা চিন্তায় ফেলেছেন মোদী-শাহদের।

Featured Book: As Author
The Real Face of Facebook in India
How Social Media Have Become a Weapon and Dissemninator of Disinformation and Falsehood
  • Authorship: Cyril Sam and Paranjoy Guha Thakurta
  • Publisher: Paranjoy Guha Thakurta
  • 214 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon
 
Featured Book: As Publisher
Encounters
  • Authorship: Ramnika Gupta
  • Publisher: Paranjoy
  • 364 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon