আসন্ন গুজরাত নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির ভরাডুবি হবে— এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা পণ্ডিতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত কার্যত শূন্য। বরং অনেকেই মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজ্যে ফের এক বার ক্ষমতায় ফিরতে তেমন বেগ পেতে হবে না বিজেপিকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তা সত্ত্বেও এত মাস ধরে কেন বার বার প্রচারের জন্য নিজের রাজ্যে ছুটে যেতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে? কেন মাটি কামড়ে এমন মরিয়া প্রচার? কেন এমন বিপুল তৎপরতা? সত্যিই কি নিজেদের মাটিতে জনতার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ভয় পাচ্ছেন মোদী-শাহ জুটি?
আগামী ১ এবং ৫ ডিসেম্বর গুজরাতে বিধানসভা ভোট। ফল ৮ তারিখে। সুতরাং, পশ্চিম ভারতের ওই রাজ্যে জনতা-জনার্দন কী ভাবছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে সেই দিনই। কিন্তু তার আগে আজকের লেখায় আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব, গুজরাতের দুর্গ রক্ষায় কেন এতখানি মরিয়া দেখাচ্ছে মোদীকে? কেনই বা উন্নয়নের ফিরিস্তি দেওয়ার পথ থেকে সরে এসে বার বার আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি?
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। অনেকেই মনে করেন, এবং হয়তো সঙ্গত কারণেই মনে করেন, মোদীকে দিল্লির মসনদে বসিয়েছে তাঁর বহুল প্রচারিত ‘গুজরাত মডেল’। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে মোদী খুব সফল ভাবে প্রচার করতে পেরেছিলেন যে, গুজরাতের মতো ‘সফল’ এবং ‘ভাল’ রাজ্য এ দেশে আর দু’টি নেই। এখানে বড়-বড় কল-কারখানা-শিল্প উপচে পড়ে। দরজায় কড়া নাড়ে বিদেশি লগ্নি। কাজের সুযোগ অফুরন্ত। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি। সব মিলিয়ে, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’।
অথচ সামাজিক ক্ষেত্রের কথা ধরলে, বহু ক্ষেত্রেই মনে হবে, এই বিপণন আসলে মরীচিকা দেখানোর মতো। কারণ, বরাবরই ব্যবসা-বাণিজ্যে গুজরাতের অর্থনীতি পোক্ত। কিন্তু শিশুদের স্বাস্থ্য-সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যানই বলে, তামিলনাড়ু ও গুজরাতের জনসংখ্যা প্রায় এক। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে মাথাপিছু বেডের সংখ্যা ওই দক্ষিণী রাজ্যে চারগুণ।
এর বাইরেও গুজরাতে অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। মদের বাড়বাড়ন্ত (খাতায়-কলমে ড্রাই স্টেট হওয়া সত্ত্বেও), মাদকের রমরমা, কৃষকদের ক্ষোভ ইত্যাদি। বাকি দেশে যে সমস্ত বিষয় এই মুহূর্তে মোদীর মাথাব্যথা, যেমন বেকারত্বের চড়া হার, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানির বিপুল দাম, সেগুলি বিজেপিকে খানিকটা বেগ দিতে পারে গুজরাতেও।
এখানেই শেষ নয়। ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় বিজেপির আসন কিন্তু সেই ২০০২ সালের পর থেকে একনাগাড়ে কমেছে। ২০০২, ২০০৭, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে তারা সেখানে জিতেছে যথাক্রমে ১২৭, ১১৭, ১১৫ ও ৯৯টি আসন। কংগ্রেসের আসন সেখানে টানা বেড়েছে। যথাক্রমে ৫১, ৫৯, ৬১ এবং ৭৭টি। তার উপরে শেষ মুহূর্তে ‘মুখ পুড়িয়েছে’ মোরবী-বিপর্যয়।
টান নেতার ক্যারিশমাতেও। ১২ বছর ২৫৭ দিন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ওই পদে আনন্দীবেন পটেলের মেয়াদ ছিল ২ বছর ৭৭ দিন। বিজয় রূপাণির ৫ বছর ৩৭ দিন। আর ডিসেম্বরে ভূপেন্দ্র ভাই পটেলের মুখ্যমন্ত্রিত্বের বয়স হবে এক বছরের সামান্য বেশি। এঁরা সকলে সময়ে কম, সম্ভবত অনেক পিছিয়ে ধারে এবং ভারেও। অতএব ভোট-বৈতরণি পার করতে ভরসা সেই মোদী।
আর এই পুরো প্রেক্ষাপট ভাল করে বোঝেন বলেই মোদী সম্ভবত আঁচ করেছেন এ বারের লড়াই শক্ত। একে যে কোনও রাজ্যের ভোটেই পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় তাঁকে এবং শাহকে। তার উপরে এ তাঁদের নিজের রাজ্য। সযত্নলালিত ভাবমূর্তি তৈরির আঁতুড়ঘর। তাই এখানে ধাক্কা খেলে যে বাকি দেশেও তার প্রভাব পড়বে, তা বিলক্ষণ জানেন মোদী। সেই কারণেই দেখে বার বার মনে হচ্ছে, গুজরাত ভোটের প্রচারে, প্রস্তুতিতে কোথাও সামান্যতম ফাঁক রাখতে চান না তিনি।
প্রথমত, গত কয়েক মাস ধরে গুজরাতে টানা একের পর এক প্রকল্প উদ্বোধন এবং শিলান্যাস করে গিয়েছেন তিনি। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই কাজে তাঁকে বাড়তি সময় দিতেই হিমাচলের সঙ্গে ভোট ঘোষণা করা হয়নি প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যে। প্রচারে স্লোগান হিসেবে বার বার মোদীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘এই গুজরাত আমিই বানিয়েছি’। রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদী আর শাহ মিলেই শুধু দেশ চালাচ্ছেন। ‘সঙ্গী’ দুই গুজরাতি ধনকুবের শিল্পপতি। রাহুলের কথায়, ‘হম দো, হমারে দো’। সেই কথার সূত্রে ‘গুজরাত অস্মিতা’ উস্কে দেওয়ার চেষ্টায় বলছেন, যাঁদের মুখে এ সব কথা শোনা যাচ্ছে, তাঁরা আদতে গুজরাতের শত্রু।
আর এই সমস্ত কিছুর পরেও বিজেপির অাস্তিনে রয়েছে হিন্দুত্বের, আরও স্পষ্ট করে বললে, হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের তাস। ২০০২ সালে গুজরাতে কী হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়। এ রাজ্যে ১০ শতাংশেরও কম মুসলিম। তাঁরা ওই রাজ্যে কতটা সুরক্ষিত খুশি, তা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনা এই ভোটমুখী রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ।
এক: গুজরাত দাঙ্গার সময়ে বিলকিস বানোকে ধর্ষণের পাশাপাশি ১২ জনকে হত্যার (যার মধ্যে ছিল বিলকিসের তিন বছরের মেয়েও) অপরাধে ১১ জনকে যেতে হয়েছিল জেলে। ১৫ অগস্ট তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে! সুপারিশ অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের!সেই উপদেষ্টা কমিটির প্যানেলে ছিলেন গোধরার বিধায়ক চন্দ্র সিংহ কুমার রাউলজি। ২০০৭ ও ২০১২ সালে কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। ২০১৭-র নির্বাচনের সামান্য আগে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ২৫৮ ভোটে জেতেন। জেল থেকে ১১ জনের মুক্তির পরে রাউলজির বক্তব্য ছিল, “এঁরা ব্রাহ্মণ, সংস্কার ভাল।” রাউলজি এ বার ফের টিকিট পেয়েছেন।
দুই: ২০০২ সালের সংঘর্ষে আমদাবাদের নারোদা পাটিয়ায় এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে পুড়িয়ে মারার পাশাপাশি ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল যাদের বিরুদ্ধে, তাদের এক জন মনোজ কুকরানি। কিন্তু খবর, এখন ‘শরীর খারাপের কারণে’ সে জেলের বাইরে। চুটিয়ে ভোট-প্রচার করছে। টিকিট পেয়েছেন মেয়ে পায়েল কুকরানি।
আরও অনেকের জেলের ভিতরে থাকার কথা, তারা বাইরে। যেমন, জয়সুখ পটেল। মোরবীতে ভেঙে পড়া ঝুলন্ত সেতু রক্ষণাবেক্ষণের বরাত পেয়েছিল তাঁর সংস্থাই। অন্তত ১৩৫ জনের মৃত্যু হল। কিন্তু জয়সুখ এখন কোথায়, কেউ জানেন না!
মোদী হয়তো ভাবেন, বিভাজনের তাস মানুষকে বাকি সব ভুলিয়ে দেবে। ঠিক যেমন অনেকে আর মনে করতে পারেন না যে, এক সময়ে ১৪৯ জন কংগ্রেসি বিধায়ককে নিয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মাধব সিংহ সোলাঙ্কি। মোদীর প্রবল রমরমার সময়েও বিজেপি ওই সংখ্যার ধারেকাছে পৌঁছয়নি।
অবশ্য এতে বিরোধীদের ‘অবদানও’ কম নয়। ২৭ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পরে যে সরকারবিরোধী হাওয়া তৈরি হয়, তা কাজে লাগানোর তাগিদ কংগ্রেসের সে ভাবে কোথায়? বরং ২০১৭ সালের পরে ২০ জন মতো বিরোধী বিধায়ক যোগ দিয়েছেন বিজেপি শিবিরে। যার মধ্যে রয়েছে হার্দিক পটেল, অল্পেশ ঠাকোরের মতো মুখও!
এ বার গুজরাতে লড়াই ত্রিপাক্ষিক। বিজেপি-কংগ্রেস-আপ। সেখানে আপ কার ভোট কাটবে, ৮ ডিসেম্বর তা স্পষ্ট হবে। কিন্তু আপাতত সিএসডিএস-লোকনীতির এক সমীক্ষা বলছে, এ বার বিজেপি, কংগ্রেস ও আপ-এর যথাক্রমে ৪৭, ২২ ও ২১ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা। অর্থাৎ, অন্তত প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে কংগ্রেসকে টপকে আপ-এর দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার সম্ভাবনা।
তবে একটা বিষয় ভোটের মুখে স্পষ্ট। তা হল, গুজরাত দখলে রাখার লক্ষ্যে প্রচারে এবং প্রস্তুতিতে অন্তত সামান্যতম ফাঁক রাখতে চাইছেন না নরেন্দ্র মোদী। ‘ইজ্জত কা সওয়াল’!