তেলের দাম কমছে: যত হাসি তত কান্না

পেট্রোলিয়মের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গত জুন মাসে বিশ্ব বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১১৫ মার্কিন ডলার, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৬০ ডলার, অর্থাত্‌ প্রায় অর্ধেক। এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। কেউ ভাবেনি, পেট্রোলিয়মের দাম ছ’মাসের মধ্যে অর্ধেক হয়ে যাবে। কেন এমন হল?

দুটি কারণের কথা বিশেষ করে বলা হচ্ছে। এক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘শেল অয়েল’ অর্থাত্‌ পাথরের খাঁজে সঞ্চিত তেলের বিরাট ভাণ্ডারের আবিষ্কার এবং তার ব্যবহারের ফলে তেলের জোগান অনেক বেড়েছে, ভবিষ্যতের চাহিদা এবং জোগানের অঙ্কও পালটে গেছে। দুই, সৌদি আরবের ভূমিকাও তাত্‌পর্যপূর্ণ। সেটা বোঝার জন্য কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া দরকার। ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছিল। তার আগে তেলের দাম ৪০ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে ১৪৭ ডলারে পৌঁছয়, আর্থিক মন্দার ধাক্কায় সেই দাম দ্রুত ফের ৪০ ডলারে পড়ে যায়। তার পর থেকে গত কয়েক বছরে তেলের চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সৌদি আরব তত্‌পর ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে তেলের দাম হু হু করে পড়া সত্ত্বেও এই দেশটি তার উত্‌পাদন কমায়নি, বরং তেলের জোগান বেশি রেখে নিজের আয় যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। আরব দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দেশটি একাই ওপেক-এর মোট তেলের জোগানের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। এটা ঠিকই যে, ১৯৮০’র দশকে বিশ্ব বাজারে ওপেক-এর যে আধিপত্য ছিল এখন তা আর নেই, ওপেক এখন মাত্র ৪০ শতাংশ তেলের জোগান দেয়। কিন্তু তা হলেও সৌদি আরব তেলের উত্‌পাদন না কমানোর ফলে দামের উপর একটা বড় প্রভাব পড়েছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব কি তেলের দাম কমানোর একটা সুপরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করছে? এখানেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা। পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ রাশিয়ার অর্থনীতি তেলের দামের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। তেলের দাম কমার ফলে ভ্লাদিমির পুতিন বিপাকে পড়েছেন— ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে এই অপ্রত্যাশিত ‘বদলা’ পশ্চিম ইউরোপকে স্বভাবতই উত্‌ফুল্ল করেছে। ইউক্রেনের ঘটনাবলির পরে অনেকেরই বক্তব্য: ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানের পরে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম দুনিয়ার টক্করই ‘সবচেয়ে ভয়ানক সংকট’। এই প্রেক্ষিতেই রাশিয়াকে ‘শিক্ষা দেওয়ার’ জন্য তেলের দাম কম রাখার চেষ্টাটা তাত্‌পর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে, পেট্রোলিয়মের বাজারে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব অত্যন্ত প্রবল হয়। প্রসঙ্গত, তেলের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিও সংকটে পড়েছে, সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক।

এ বার আসা যাক তেলের দাম কমার ফলাফলের কথায়। ভারতের দিক থেকেই ব্যাপারটা দেখা ভাল। ভারতকে তার পেট্রোলিয়মের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার তাত্‌ক্ষণিক সুফল বিরাট। বাজারদরে সেই সুফল ইতিমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। তেলের দাম, এবং অন্যান্য পণ্যের দাম কমার ফলে ভারতে মূল্যস্ফীতির হার যতটা কমেছে, দশ বছরের মধ্যে তেমনটা ঘটেনি। অমিত শাহ বিভিন্ন জনসভায় এটাকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সাফল্য হিসেবে জাহির করে বেড়াচ্ছেন বটে, কিন্তু সত্যটা হল, এই সরকারের ভাগ্য আশ্চর্য রকমের ভাল।

অন্য দিকে, দাম কমার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত পেট্রোলিয়মের উপর আমদানি এবং উত্‌পাদন শুল্ক বাড়িয়ে নিজের রাজস্ব বাড়িয়েছে। পেট্রোলিয়ম শিল্পের কাছ থেকে কর আদায় করা সহজ। শুধু তা-ই নয়, সচরাচর কেন্দ্রীয় সরকারের মোট উত্‌পাদন শুল্ক আদায়ের এক-তৃতীয়াংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আসে এই সূত্রে। যেমন, ২০১৩-১৪ সালে সরকারের মোট উত্‌পাদন শুল্ক আদায় হয়েছিল ১৭৯,০০০ কোটি টাকা, তার মধ্যে ৭৭,০০০ কোটি, অর্থাত্‌ এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছিল পেট্রোলিয়ম থেকে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে: সামনের মাসের শেষে তিনি আগামী অর্থবর্ষের (২০১৫-১৬) যে বাজেট পেশ করবেন, তাতে রাজকোষ ঘাটতির (ফিসকাল ডেফিসিট) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা তাঁর পক্ষে তুলনায় সহজ হবে। অর্থমন্ত্রীর আসনে বসে তাঁর অনুমান ছিল, তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলারের কাছাকাছি থাকবে, দাম এখন তার অর্ধেক। রাজকোষ ঘাটতিকে জিডিপি’র ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্যমাত্রা এক সময় অসম্ভব মনে হয়েছিল, এখন সেটা প্রায় ছেলেখেলা।

কিন্তু তেলের দাম কমেছে বলে আমরা যদি আহ্লাদে আটখানা হই, সেটা বুদ্ধির পরিচয় হবে না। কারণ এর ফলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, বিশেষত ভবিষ্যতে। প্রথমত, পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি উত্তাল। ইরাক ভিতর থেকে ভেঙে পড়ার মুখে। তিন বছরের বেশি হয়ে গেল, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ অব্যাহত। লিবিয়ার রাজনৈতিক সংকটের আশু সুরাহা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পেট্রোলিয়মের বাজারে আকস্মিক সংকট এবং তার ফলে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

যদি সেই আশঙ্কা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখি, তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায়। বিশ্ব বাজারে চাহিদার অভাব এখনও প্রবল। এটা লক্ষ করার ব্যাপার যে, শীতের মরসুমে ঠান্ডার দেশে জ্বালানির চাহিদা বাড়ে, তাই দামও সচরাচর ঊর্ধ্বমুখী হয়। এ বার যে দাম এতটা কমছে, তার পিছনে পশ্চিম ইউরোপে ও জাপানে মন্দার একটা ভূমিকা আছে, ভূমিকা আছে রাশিয়ার আর্থিক সমস্যার এবং চিনের অর্থনীতির গতিভঙ্গেরও। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অবস্থা ভারতের রফতানির পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। ইউরোপে ও জাপানে মন্দা এবং চিনে অর্থনীতির গতিভঙ্গের ফলে ভারতের রফতানিতে ভাটার টান থাকবে বলেই মনে হয়। তার ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি খাতে ঘাটতি বাড়তে পারে, টাকার দাম কমতে পারে।

তেলের দাম কমার ফলে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোলিয়ম কোম্পানিগুলির হিসেবের খাতায় বড় রকমের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তারা আগে চড়া দামে তেল কিনেছিল, এখন সেই মজুত ভাণ্ডারের দাম হঠাত্‌ কমে গেছে, যাকে বলা হয় ‘ইনভেনটরি লস’। তার ফলে, ২০১৩’র জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিক পর্বে যেখানে ইন্ডিয়ান অয়েল-এর ১৬৮৩ কোটা টাকা লাভ হয়েছিল, ২০১৪’র একই পর্বে সেখানে লোকসান হয়েছে ৮৯৮ কোটা টাকা; আইওসি-র মজুত তেলের মূল্য কমেছে ৪২৭২ কোটা টাকা। পেট্রোকেমিক্যালস-এর মতো অন্য একাধিক বাজারেও বিভিন্ন কোম্পানির একই সমস্যা হয়েছে।

জ্বালানি নীতি এবং পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দাম হঠাত্‌ এত কমে যাওয়ায় পেট্রোলিয়মের বাজারে হিসেবের অঙ্কে ওলটপালট হয়েছে, তার ফলে তেল এবং গ্যাস সন্ধানের নানা প্রকল্প আটকে গেছে, সে জন্য নির্ধারিত প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ এখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায়। ভবিষ্যত্‌ জোগানের উপরে এর প্রভাব পড়তে পারে। অন্য দিকে, তেলের দাম এত কমে গেলে জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের চাপটা কমে যাবে, বিশ্ব পরিবেশের পক্ষে সেটা ভাল নয়। পাশাপাশি, সৌর বা বায়ু বিদ্যুতের মতো শক্তির উত্‌পাদনে ও গবেষণায় বিনিয়োগ নিরুত্‌সাহ হবে, ভবিষ্যতের পক্ষে তার পরিণামও ক্ষতিকর। লক্ষ করার বিষয়, এ বার শীতে দিল্লিতে যে পরিমাণ বায়ু দূষণ দেখা গেছে, তাতে সে দুনিয়ার সবচেয়ে দূষণ-আক্রান্ত শহরগুলির তালিকায় স্থান পেয়ে গেছে। দিল্লি একা নয়, দেশের বহু শহরের অবস্থাই ভয়াবহ।

তাই বলছি, তেলের দাম পপাত চ মমার চ বলে উত্‌ফুল্ল হওয়ার আগে সব দিক ভেবে নেওয়া ভাল।

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Featured Book: As Publisher
Kashmir
A Noble Tryst in Tatters