শি শুশিক্ষায় যাতে কোনও বাধা না পড়ে, সেই উদ্দেশ্যেই নাকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০১২ সালের শিশু শ্রম নিবারণী আইনে নতুন সংশোধনী যোগ করার সিদ্ধান্ত হল। অতঃপর শিশুরা আইনত বাড়িতে ও পারিবারিক ব্যবসায় কাজ করতে পারবে। তাতে ভারতীয় সমাজের নিজস্ব কাঠামোটির কী লাভ হবে, নরেন্দ্র মোদীই জানেন— কিন্তু, যে উদ্দেশ্যে এ আইন তৈরি হয়েছিল, তার মূলে আঘাত করল এই সংশোধনী। শোষণ থেকে শিশুদের বাঁচানোর রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গেল।
১৯৮৬ সালের শিশুশ্রম নিবারণী আইনে বলা হয়েছিল, শিশুদের ১৮টি নির্দিষ্ট পেশায়, এবং ৬৫ ধরনের কাজে, নিয়োগ করা চলবে না। শিশু শ্রমিক নিয়োগ করতে হলে কাজের পরিবেশ কী রকম হতেই হবে, আইনে সে কথাও বলা ছিল। অন্য দিকে, শিক্ষার অধিকার আইনে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের বিনামূল্যে ও আবশ্যিক ভাবে স্কুলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এই বয়সের শিশুরা যাতে কাজ করতে যাওয়ার বদলে স্কুলেই যেতে পারে, তা নিশ্চিত করা নতুন বিলটির ঘোষিত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, এই বিলের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী আগেকার দুটি আইনকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চান।
১৯৮৬ সালের আইনটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) নীতির পরিপন্থী। অথচ, মনে রাখা ভাল, ভারত এই সংগঠনের সদস্য। সংগঠনের ১৩৮তম কনভেনশন অনুযায়ী, স্কুলে বাধ্যতামূলক পড়াশোনা শেষ হওয়ার বয়স না হওয়া পর্যন্ত কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। ১৮২তম কনভেনশন বলছে, ১৮ বছরের নীচে কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা বাঞ্ছনীয়। এ দিকে, ভারতের আইন অনুযায়ী, ১৪ বছর বয়স পার হলেই কাউকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেও নিয়োগ করা যাবে। নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে এই গোলমালগুলোরও সমাধান করার চেষ্টা হয়েছে।
‘শিশু’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? নতুন সংশোধনী বিল বলছে, যাদের বয়স এখনও ১৪ পেরোয়নি (অথবা শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী যাদের আবশ্যিক লেখাপড়া এখনও শেষ হয়নি), তারা প্রত্যেকেই শিশু। ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট-এ শিশুর যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছিল, এই নতুন সংজ্ঞার সঙ্গে তার ফারাক রয়েছে। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮, তাদের ‘বয়ঃসন্ধি’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। এই সংজ্ঞাটিও ১৯৪৮ সালের আইনের চেয়ে সামান্য আলাদা। নতুন বিলে বলা হয়েছে, মাত্র দুটি ব্যতিক্রম বাদে আর সমস্ত ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
যে দুটি ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে, সেগুলি হল পরিবার বা পারিবারিক ব্যবসা, এবং বিনোদনশিল্প ও খেলাধুলা। তবে, তাতেও বাধানিষেধ রয়েছে। যেমন, পারিবারিক ব্যবসার কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হলে শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন কাজের ক্ষেত্রেও শিশুদের কাজ করানো যাবে স্কুলের সময়ের পর অথবা ছুটির মধ্যে। সার্কাস বাদে বিনোদনের অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন বিজ্ঞাপন, ফিল্ম, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি এবং খেলাধুলায় শিশুদের কাজ করানো যাবে, তবে দেখতে হবে, কাজের জায়গার যেন সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলি মানা হয়, ও কাজ করতে গিয়ে যেন লেখাপড়ার ক্ষতি না হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় বা কাজে শিশুদের নিয়োগ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কথা বলেছে বিলটি। কেউ সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে অতঃপর তা ‘কগনিজেবল অফেন্স’ বা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, অর্থাৎ আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়াই তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারবে পুলিশ। শিশুশ্রম সংক্রান্ত আইনে জরিমানার পরিমাণ অনেকখানি বাড়ানোর প্রস্তাবও আছে বিলে। তবে, মা-বাবার ক্ষেত্রে ছাড় আছে। বলা হয়েছে, তীব্র দারিদ্রের তাড়নায় অভিভাবকরা সন্তানকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করতে বাধ্য হন, কাজেই তাঁদের জন্য জরিমানার নিয়ম শিথিল করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বিলটি নিয়ে অনেকেই তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, শিশু শ্রম বিলোপ করাই যে সরকারের ঘোষিত নীতি, তারা কি কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শিশু শ্রমিক নিয়োগের আইনি ছাড়পত্র দিতে পারে? নোবেলজয়ী শিশু-অধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী বলেছেন, ‘পারিবারিক ক্ষেত্র’ বলতে কী বোঝায়, সেই সংজ্ঞা স্পষ্ট ভাবে বেঁধে না দিলে তার অপব্যবহার হতেই পারে। ‘বাড়ির কাজে হাত লাগানো’ বা নির্দিষ্ট পারিবারিক পেশায় হাত পাকানোর নামে শিশুদের শোষণ করা হতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকেরই।
শিশুশ্রম বিরোধী আইন তো ভারতে দীর্ঘ দিন ধরেই আছে। তবুও দেশের আনাচেকানাচে অজস্র শিশু কি প্রায়ান্ধকার ঘুপচি ঘরে বসে সেলাই বা এমব্রয়ডারির কাজ করছে না, শৌখিন কার্পেটে সূক্ষ্ম নকশা ফুটিয়ে তুলছে না, দেশলাই অথবা বাজি বানাচ্ছে না, বিড়ি বাঁধছে না, ধাবায় বাসনকোসন ধুচ্ছে, সবজি কাটছে না? তাদের শরীরে বিষাক্ত কীটনাশক ঢুকছে, সার ঢুকছে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ভয়ঙ্কর রকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু, এই কাজগুলোয় শিশুদেরই চাহিদা। একে তো তাদের মজুরি কম দিতে হয়, তার ওপর বড়দের তুলনায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা ঢের সহজ।
শিশুশ্রম নিবারণী আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলটিতে সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ‘(শ্রম ও কর্মসংস্থান) মন্ত্রক কী ভাবে বাড়ির অভ্যন্তরে কাজ করতে বাধ্য হওয়া শিশুদের ওপর নজর রাখবে, কমিটি সে কথা বুঝতে পারেনি। আইনে ছাড়ের ব্যবস্থা করে মন্ত্রকই আইনটিকে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা খুলে দিচ্ছে। শিশুরা মা-বাবাকে সাহায্য করছে, নাকি তারাও পরিবারের জন্য রোজগার করতে বাধ্য হচ্ছে, বোঝার উপায় কোথায়? স্কুলের সময়টুকু বাদে কাজ করায় আর কোনও আইনি বাধানিষেধ না থাকায় তাদের লেখাপড়া তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, বিশ্রামের অভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও বাধা পড়বে।’
স্ট্যান্ডিং কমিটির মতে, ‘বিপজ্জনক কাজ’ কাকে বলে, সেটা নতুন করে স্থির করা হোক। যে কাজ শিশু বা বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে এবং যাতে তাদের মানসিক গঠনের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, এমন সব কাজকেই ‘বিপজ্জনক’ বলে চিহ্নিত করা হোক। শিশুশ্রমের সঙ্গে শিশুপাচারের বিষয়টিও জড়িত। পাচার হওয়া শিশুদের সঙ্গে কার্যত অমানবিক ব্যবহার করা হয়। তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়, চোরাই ড্রাগের ব্যবসায় নামানো হয়, এবং তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। স্ট্যান্ডিং কমিটি প্রশ্ন তুলেছিল, বিলে এই প্রসঙ্গটি নেই কেন? শ্রম মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে, এই বিষয়গুলি নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতায় পড়ে।
উত্তরটি স্ট্যান্ডিং কমিটিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তীব্র ভাষায় কমিটি বলেছে, শ্রম মন্ত্রক এমন জরুরি প্রশ্নে যে রকম দায়সারা উত্তর দিয়েছে, তা কমিটির সদস্যদের মতে নিন্দনীয়। ভারতের বিভিন্ন শহরে ট্রাফিক সিগনালে ভিক্ষা করা বা খুচরো জিনিস ফেরি করে বেড়ানো ছেলেমেয়েদের সংখ্যা তো কমেনি। অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহভৃত্য বা কাগজকুড়ানির সংখ্যা কমেনি। কমিটির মতে, এই সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন মন্ত্রকের এক সঙ্গে একটি সার্বিক নীতি তৈরি করা প্রয়োজন।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশনের ৬৬তম রাউন্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে ২০০৯-১০ সালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ। আবার, ২০০১ সালের জনসুমারির তথ্য বলছে, সংখ্যাটি প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ। শিশুদের উন্নয়নের জন্য, এবং তাদের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে মিড ডে মিলের মতো বেশ কয়েকটি সরকারি প্রকল্প চালু আছে। কিন্তু, স্পষ্টতই তাতে শিশুশ্রমিকের সমস্যা কমেনি।
অস্বীকার করা চলে না, সম্প্রতি ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। তবুও, বহু শিশু এখনও স্কুলের বাইরে থেকে গিয়েছে। একটা প্রাথমিক প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন— বিপজ্জনক নয়, এমন ক্ষেত্রে যদি শিশুদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তারা স্কুলেও যেতে পারবে তো? একই সঙ্গে লেখাপড়া আর কাজ চালিয়ে যাওয়ার চাপ সামলাতে পারবে তো তাদের ছোট্ট শরীরগুলো?
উত্তর অনুমান করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই মুহূর্তে প্রস্তাবিত বিলটি প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রয়োজন। যে আইন শিশু ও কিশোরদের কাজ করতে পাঠায়, তার মতো মারাত্মক আইন আর কিছু হতে পারে না।