এই মাপের দুর্নীতি ভারতেও বিরল

দুর্নীতি দেখেনি, এমনটা নয়। প্রতাপশালী রাজনীতিক, প্রভাবশালী আমলা আর মহাকোটিপতি ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র আমাদের চেনা। তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্ত বা সাক্ষী খুন? তা-ও বহু বার দেখেছে ভারত।

তা হলে ব্যপম কাণ্ডে এমন কী হল, যার ধাক্কায় শিবরাজ সিংহ চৌহানের দশ বছরের পুরনো মসনদও টলমল করছে, দিল্লিতে বিজেপি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? নরেন্দ্র মোদীর মুখে কুলুপ, বিজেপি-র অন্য অনেক নেতা হরেক কুযুক্তি সাজিয়ে বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করছেন, এবং আশঙ্কা হচ্ছে, সেই চেষ্টা বুমেরাং হয়ে ধেয়ে আসতে পারে ভোপাল ও দিল্লির সরকারের দিকে?

আপাতদৃষ্টিতে ধাঁধাই বটে। ব্যপম কেলেঙ্কারি হল বিভিন্ন সরকারি চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে— বিশেষত মেডিক্যাল কলেজে— ভর্তির পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুর্নীতির এক জটিল আবর্ত। বলতেই পারেন, এ আর নতুন কী! দেশটার নাম যখন ভারত, এমন ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার মতো কী হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় সম্ভব নয়। আসলে ব্যপম কেলেঙ্কারি এমন একটি ঘটনা, যার তুলনা ভারতে তো বটেই, গোটা দুনিয়ায় পাওয়া দুষ্কর।

এ কেলেঙ্কারির সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু, গোটা দেশের সংবাদ শিরোনামে তার নিয়মিত উপস্থিতি কয়েক সপ্তাহের ঘটনা। ভারত এ যাবৎ কাল ক্ষমতার যত রকম অপব্যবহার দেখেছে, সরকারি চাকরিতে বা ডাক্তারির মতো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঘুষ নিয়ে ভর্তির যত উদাহরণ দেখেছে, ব্যপম ঠিক কোথায় সেগুলোর থেকে আলাদা? কোথায় আরও মারাত্মক, শিরদাঁড়া দিয়ে আরও ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর?

সম্ভবত এর উত্তর: কেলেঙ্কারির মাপে। এই দুর্নীতি এতটাই বিস্তৃত, এতটাই গভীর যে তা ভারতীয় দুর্নীতি নিয়ে তিতিবিরক্ত, পোড়-খাওয়া মানুষকেও চমকে দিতে পারে। মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চন্দ্রেশ ভূষণের নেতৃত্বে ব্যপম কেলেঙ্কারির তদন্তের জন্য এক স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছিল (এখন তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে)। তার স্টেটাস রিপোর্ট বলছে, সরকারি হিসেবেই এখনও অবধি এই মামলায় অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন অন্তত ২৪ জনের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে।

স্টেটাস রিপোর্টটি পেশ করা হয়েছিল গত মাসের ২৬ তারিখ। তার পরেও বেশ কয়েকটি রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। মৃতের তালিকায় অভিযুক্তরা রয়েছেন, সন্দেহভাজনরা রয়েছেন, তাঁদের পরিবারের লোকজন রয়েছেন, সাক্ষী রয়েছেন। এমন মৃত্যুও রয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে যাকে আত্মহত্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এখনও অবধি ব্যপম কেলেঙ্কারিতে মোট কত জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, সেই সংখ্যাটি নিয়েও বহু মত। কারও মতে, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ। কারও মতে তিন গুণ, কারও মতে ছয় গুণের বেশি। কে দাবি করছেন, হিসেবটা অবশ্য তার ওপর নির্ভরশীল। দেখা যাচ্ছে, মৃতের তালিকায় কুড়ির কোঠায় থাকা ছেলেমেয়েদের সংখ্যা অনেক। তাঁরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অথবা নিচু তলার সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের দালালদের হাতে মোটা টাকা তুলে দিয়েছিলেন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর তালিকায় মামলার অভিযুক্ত ও সন্দেহভাজনরাও আছেন। সরকারি অফিসাররাও আছেন। মৃতের তালিকায় রয়েছে মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল, প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা, রামনরেশ যাদবের ছেলে শৈলেশ যাদবের নামও। তালিকাটি সব মিলিয়ে চমকপ্রদ।

মামলায় এখনও অবধি প্রায় ২০০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের হিসেবে, শ’খানেক সন্দেহভাজন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় দুশো জন পিটিশন দাখিল করে জানিয়েছেন, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন যে তাঁদেরও খুন করা হতে পারে। মামলায় জড়িয়ে গিয়েছে অনেকগুলো ওজনদার নাম। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী, বিজেপি-র সর্বভারতীয় মুখপাত্র সুধাংশু মিত্তল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সুরেশ সোনি ও প্রভাত ঝা। এ ছাড়াও নাম জড়িয়েছে রাজ্যের বেশ কিছু মন্ত্রী ও সাংসদের।

বছর দুয়েক আগে আনন্দ রাই নামক এক ‘হুইসল ব্লোয়ার’-এর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ ইন্দোর থেকে আট জনকে গ্রেফতার করে। প্রি-মেডিক্যাল পরীক্ষায় তারা নাম ভাঁড়িয়ে অন্যদের হয়ে পরীক্ষা দিতে বসেছিল। সেই গ্রেফতারির সূত্র ধরেই ব্যপম কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য জনসমক্ষে আসে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে শিবরাজ সিংহ চৌহান বিধানসভায় জানান, স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের তদন্তে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি এবং সরকারি চাকরির নিয়োগে অন্তত ১০০০টি ভুয়ো ঘটনা ধরা পড়েছে। তবে, কেলেঙ্কারিটি কিন্তু আরও অনেক পুরনো— অন্তত আরও দশ বছর আগে এর সূচনা।

তা হলে হঠাৎ এত দিন পরে এত হইচই আরম্ভ হল কেন? সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল টাস্ক ফোর্সকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল— ১৫ জুন ২০১৫ তারিখের মধ্যে রিপোর্ট জমা করতেই হবে। সেই তারিখ যত এগিয়ে আসতে থাকে, এসটিএফ তদন্তে ততই জোর দেয়। এবং, তখনই একের পর এক রহস্যজনক মৃত্যু ঘটতে থাকে। এক সর্বভারতীয় হিন্দি নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক অক্ষয় সিংহ ব্যপম কাণ্ডের খবর করতে গিয়ে রহস্যজনক ভাবে মারা যান। তার পরই ন্যাশনাল মিডিয়ার একেবারে উপরে উঠে আসে ব্যপম কেলেঙ্কারি। প্রশ্ন ওঠে, ডাক্তারির মতো পেশায় যদি যোগ্যতার বদলে ঘুষ দিয়ে প্রবেশ করা যায়, তবে সেই ডাক্তারদের হাতে যাদের জীবনের ভার, সেই সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের কী হবে? এবং, যাঁরা ঘুষ না দিয়ে, নিজেদের যোগ্যতার জোরেই ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের মানুষ আলাদা করে চিনবেন কী করে? ঘুষের ডাক্তারদের জন্য কি তাঁরাও নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন?

বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার দায় শিবরাজ সিংহ চৌহানের। তাঁর সমর্থকরা বহু দিন দাবি করে আসছেন, তিনি সুদক্ষ প্রশাসক, তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বে রাজ্যের কৃষকদের উন্নতি হয়েছে, কৃষি উৎপাদন প্রচুর বেড়েছে, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে ইত্যাদি।

তদন্তের ফল যা-ই হোক না কেন, ব্যপম কেলেঙ্কারি নিঃসন্দেহে তাঁর ভাবমূর্তিতে জোরালো ধাক্কা দিল।

‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান’ উপন্যাসটি আগাথা ক্রিস্টির সবচেয়ে বাণিজ্যসফল বই। (১৯৩৯’এ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ছিল ‘টেন লিটল নিগারস’) প্রায় দশ কোটি কপি বিক্রি হয়েছিল বইটি। সেই বইয়ের গল্প দশ আসামির। অপরাধী হলেও তারা শাস্তি এড়িয়ে পালাতে পেরেছিল। এক দ্বীপে গিয়ে পৌঁছেছিল তারা। একে একে দশ জনই মারা গেল। লেখার পোস্টস্ক্রিপ্টে ছিল এক স্বীকারোক্তি। তা থেকেই জানা গিয়েছিল, কী ভাবে মৃত্যু হয়েছিল তাদের।

বাস্তব কিছু ক্ষেত্রে কল্পকাহিনির চেয়েও বিচিত্র। ব্যপম কাণ্ড থেকে যখন রহস্যের পর্দা উঠবে, অনুমান করছি, দেখা যাবে যে সেই সত্য বিশ্বের সর্বকালীন রহস্য রোমাঞ্চ বেস্টসেলারের চেয়েও ভয়াবহ।

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Featured Book: As Publisher
Corruption, CBI and I
More than Memoirs of a Veteran Scam-Buster
  • Authorship: Shantonu Sen with Sanjukta Basu
  • Publisher: Paranjoy Guha Thakurta
  • 260 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon