আগামী তিন মাস ভারতীয় রাজনীতিতে যে বিষয়টির উপর সবচেয়ে বেশি নজর থাকবে, সেটি হল বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফল কী হয়, জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির পক্ষে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হতে বাধ্য। নীতীশ কুমারকে সামনে রেখে জেডিইউ এবং আরজেডি’র যে জোটটি ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ, বিজেপি ও তার সঙ্গীরা যদি তাকে হারিয়ে বিহারে ক্ষমতা দখল করতে পারে, তা হলে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থকরা আরও অনেক জোর গলায় বলবেন, তিনিই ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’-এর অবিসংবাদী সর্বাধিনায়ক। কিন্তু যদি সেটা না হয়, তা হলে মোদীকে তাঁর দলের কর্পোরেট-বান্ধব নীতি ও ঝোঁকটা বদলে ফেলে জনমনোরঞ্জনে মন দিতে হবে।
মোদী এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বুঝতে পেরেছেন, ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করে তাঁরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অনুকূল জমি আইন প্রণয়নের যে কাজটি করতে চান, তা পেরে উঠবেন না। তাঁদের মনে এখন এই উদ্বেগ জোরদার হচ্ছে যে, তাঁদের গায়ে ‘দরিদ্র-বিরোধী’ এবং ‘কৃষক-বিরোধী’ তকমা লেগে গেছে। বিজেপি এবং কংগ্রেস দেশের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, দুইয়ে মিলে দেশের অর্ধেকের বেশি লোকের ভোট পায়। এই দু’দলের আর্থিক নীতি প্রায় একই রকম। বিজেপি বিহার নির্বাচনে জিততে না পারলে সেই সাদৃশ্য আরও বেশি বলে মনে হবে।
কিন্তু, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে একটা গুরুতর তফাত আছে। সেটা হল ‘এম’ ঘটিত। ভারতের প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ মুসলমান, তাঁদের অধিকাংশই বিজেপিকে বিশ্বাস করেন না। বিহারে হারলে মোদী আর্থিক নীতিতে জনমনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে পারেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি হয়তো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দুত্বের ছকটিতে আরও বেশি জোর দেবেন। সঙ্ঘ পরিবারের কট্টরপন্থীদের বিদ্বেষপূর্ণ নানা মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এখনও সাড়া দেননি, নিজের একটা ‘সর্বজনীন’ ভাবমূর্তি পেশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু আগামী দিনগুলিতে তিনি হয়তো আরএসএস-এর সামাজিক লক্ষ্যগুলি পূরণের ব্যাপারে নিজেকে অনেক কম সংযত রাখবেন।
বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ কোনও দিনই বিজেপির ভিতরে মোদীর সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন না। তবুও ললিত মোদীকে ‘সাহায্য’ করার অভিযোগে সুষমা স্বরাজকে শাস্তি দেওয়ার যে দাবি উঠেছে, মোদী এখনও তা মেনে নিতে পারেননি। তেমনই, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ছেলের সঙ্গে ‘অন্য’ মোদীর মধুর সম্পর্কের ব্যাপারটার সঙ্গে রবার্ট বঢ্রার জমি লেনদেন সংক্রান্ত অভিযোগের সাদৃশ্য আছে, তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বসুন্ধরার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি। স্বভাবত বাক্পটু নরেন্দ্র মোদী এই সব প্রশ্নে নীরবতাকেই শ্রেষ্ঠ কৌশল সাব্যস্ত করেছেন। শিবরাজ সিংহ চৌহানের ক্ষেত্রেও একই ছবি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসন এবং সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে বিপুল দুর্নীতির ‘ব্যপম কেলেঙ্কারি’ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখেও প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে পারেননি। পূর্বসূরি মনমোহন সিংহের মতোই নরেন্দ্র মোদীও নিজের দলের মধ্যে কোনও অন্যায় শুনতে পান না, দেখতে পান না, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেন না।
এই সরকারের মেয়াদ ২০১৯ সালের মে মাস অবধি। তত দিনে অনেক কিছু ঘটতে পারে, ঘটবেও। কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, গত ১৯ জুন পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে ছেচল্লিশে পা দেওয়া রাহুল গাঁধী যে অতিরিক্ত আগ্রাসী ভঙ্গিতে বিরোধিতার পথ বেছে নিয়েছেন, তাঁকে সেই পথেই চলতে হবে। তাঁর মা যেমন নিজের আগ্রাসনকে নিয়ন্ত্রিত রাখেন— তিরুঅনন্তপুরমের দলীয় সাংসদ শশী তারুর সংসদের কাজ পণ্ড করা উচিত নয় বলায় সনিয়া গাঁধী কেবল তাঁকে জনসমক্ষে তিরস্কার করেছেন— তাঁর পুত্রের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। লোকে মনে করে রাহুলবাবা নেহাতই বড়লোকের আদুরে সন্তান, কোনও কাজের নন, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দলটিকে তার দুর্বলতম অবস্থা থেকে তুলে আনার চেষ্টাটাও তিনি পুরোপুরি করে উঠতে পারেন না, কেমন যেন সংকুচিত ভাব তাঁর। তিনি এই ভাবমূর্তিটা কাটাতে চেষ্টা করছেন, তাই আগুনখোর বামপন্থীদের ভাষায় কথা বলছেন। ভারতীয় রাজনীতির কর্দমাক্ত রাস্তায় তিনি কত দিন চলতে পারবেন? বিহারে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের দিকে সকলের নজর থাকবে। আরজেডি’র লালুপ্রসাদকে তিনি একটু পিছনে থাকতে রাজি করিয়েছেন, এ বার নীতীশ কুমারের এক জন যোগ্য সহায় হয়ে উঠতে পারবেন কি?
পটনা শহরটা নীতীশ কুমারের ছবিওয়ালা হোর্ডিংয়ে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বিহার পটনা নয়। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র প্রচারবিশারদরা ভারতের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে একটা আমেরিকান মডেলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেহারা দিয়েছিলেন। লড়াইটা যেন দাঁড়িয়েছিল দুই ব্যক্তির মধ্যে, যাঁরা নিজের নিজের দলের চেয়ে অনেক বড়। মোদী এবং গাঁধীর সেই দ্বৈরথে কার জিত হয়েছে, সেটা আমরা জানি।
কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি হল শাঁখের করাত, দু’দিকেই কাটে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি যখন বিপুল ভাবে জয়ী হল, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, ন’মাসের মধ্যে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টির হাতে তারা কচুকাটা হবে, ভোটপ্রাপ্তির হার প্রায় কুড়ি শতাংশ কমে যাবে। এই পরিণাম থেকে নীতীশ কুমারের যেমন শেখার আছে, তেমনই শেখার আছে বিজেপিরও। লক্ষণীয়, তারা আর এক মোদীকে— বিহারের ভূতপূর্ব উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেনি।
নীতীশ কুমারের দায়িত্ব রাজ্যের ভোটদাতাদের একটা বড় অংশকে এ কথা বোঝানো যে, তিনি প্রশাসক হিসেবে দক্ষ। কিন্তু শুধু তা নয়। দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি বিজেপি’র সঙ্গী ছিলেন এবং লালুপ্রসাদ যাদব ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ। ২০০২ সালে গোধরা-উত্তর গুজরাতে যখন ভয়াবহ কাহিনি রচিত হচ্ছে, তিনি তখন কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর রেলমন্ত্রী। আজ তিনি লালুপ্রসাদের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট লড়ছেন, বলছেন নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে তিনি ঘৃণা করেন। এই আত্মসংশোধনের যৌক্তিকতাও ভোটদাতাদের বোঝাতে হবে তাঁকে। এবং এটাও তাঁর একমাত্র ‘ভুল’ নয়, জিতনরাম মাঁজিকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসানোর জন্য নীতীশ কুমার জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছেন— মাঁজির আচরণ তাঁকে যৎপরোনাস্তি বিব্রত করেছে এবং মাঁজি এখন, প্রত্যাশিত ভাবেই, বিজেপির শিবিরে যোগ দিয়েছেন।
লালুপ্রসাদ নীতীশ কুমারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বটে, কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ হল আরজেডি ও জেডিইউ-এর সাধারণ কর্মীদের এত বছরের বিরোধ মিটিয়ে একসঙ্গে কাজ করানো এবং এটা নিশ্চিত করা যে, যাঁরা আরজেডিকে বরাবর ভোট দিয়ে এসেছেন, তাঁদের ভোটটা যাতে প্রয়োজন মাফিক জেডিইউ-এর ঝুলিতে ‘স্থানান্তরিত’ হয়। আর্থিক ভাবে অনগ্রসর এই রাজ্যে জাতপাতের কাঠামো ও তার রাজনৈতিক প্রভাব জটিল। একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়। বিহার কি বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পথ দেখাতে পারবে?