দিদি আর দাদার মধ্যে কুরুক্ষেত্র বেধে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত বড় স্পর্ধা যে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন: অমিত শাহ কে? উত্তর মিলল রবিবার, কলকাতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি ঘোষণা করলেন: তিনিই তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে একেবারে বাংলা-ছাড়া করবেন। বক্তৃতার লড়াই থাকুক, কিন্তু এই রাজনৈতিক দ্বৈরথ যে ভাবে চলছে এবং যে দিকে যাচ্ছে, সেটা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। চল্লিশের দশকে বাংলায় যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা গিয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে তার তুলনা কমই আছে। তার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় একটা সম্প্রীতি দেখা গেছে। সেই প্রেক্ষিতেই এখনকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করার পরে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে রাজনীতি যে বিচিত্র এবং জটিল চেহারা নিয়েছে, সেটা বিশেষ কেউ অনুমান করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। এই দ্বিমুখী অভিযানের এক দিকে রয়েছে সারদা অর্থ লগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত, অন্য দিকে বর্ধমান জেলায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে অনুসন্ধান। প্রধানমন্ত্রীর ডান হাত অমিত শাহ রাখঢাক না করে অভিযোগ করেছেন, সারদা গোষ্ঠীর টাকা কেবল মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের পকেটেই যায়নি, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপেও সে টাকা লাগানো হয়েছে। এই বিভিন্ন ব্যাপারগুলো এমন ভাবে জট পাকিয়ে গেছে যে আশঙ্কা হয়, পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক হিংসা দেখা যাবে, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক হিংসা। এই উদ্বেগ মিথ্যে প্রমাণিত হলেই মঙ্গল।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের ইতিহাস নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। কিন্তু যে কথাটা আমরা সচরাচর ভুলে যাই তা হল, গত চার দশকে এই রাজ্যের বহু দরিদ্র এবং সরলপ্রাণ মানুষ বার বার অর্থলগ্নির বাজারে সক্রিয় হাঙরদের পাল্লায় পড়ে সব খুইয়েছেন। ওভারল্যান্ড গোষ্ঠীর কীর্তিকলাপের কাহিনি এখনও অনেকের স্মৃতিতেই তাজা, কিন্তু অন্তত বাংলার বাইরে কম মানুষেরই মনে আছে সঞ্চয়িতা গোষ্ঠীর অন্যতম মালিক শম্ভু মুখোপাধ্যায়ের কথা, তাঁর গ্রুপের গোলমাল ধরা পড়ে যাওয়া এবং আইনি ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পরে যিনি খুবই সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করেছিলেন।
সমস্ত পন্জি স্কিম-এর মধ্যে একটা ব্যাপারে মিল আছে। (এই নামটা এসেছে চার্লস পন্জির নাম থেকে। ১৯২০-র দশকে মার্কিন ব্যবসায়ী চার্লস পঞ্জি বিনিয়োগ প্রকল্পের নামে প্রতারণার কারবার চালিয়েছিলেন, নতুন লগ্নি জোগাড় করে সেই টাকায় তিনি পুরনো লগ্নিকারীদের ভাল ডিভিডেন্ড দিতেন।) এই ধরনের কারবারিদের নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকে না, যখন যে ক্ষমতায় থাকে, এরা তখন তার কাছে আসার চেষ্টা করে। সারদা গোষ্ঠীর সুদীপ্ত সেনও এর ব্যতিক্রম নন। তাই কয়েক বছর আগে বামফ্রন্টের কাছে থাকলেও ঝোপ বুঝে তৃণমূলের সঙ্গী হতে তাঁদের কোনও অসুবিধে হয়নি। লক্ষণীয়, ওডিশা এবং অসমে সারদার সহযোগীরা যথাক্রমে বিজেডি’র নবীন পট্টনায়ক এবং কংগ্রেসের তরুণ গগৈয়ের কাছের লোক ছিলেন।
মোদ্দা কথা, সারদা গোষ্ঠীকে কারা অতীতে মদত দিয়েছেন (মানে বামফ্রন্টের লোকেরা), সে বিষয়ে প্রচার চালিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু দূর অবধি সুবিধে হতে পারে। একই ভাবে, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে সিবিআই ও ইডি আর বর্ধমান বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে এনআইএ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আচরণ করছে, বিজেপি সরকার তাদের দিয়ে এ-সব করাচ্ছে এই প্রচার তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সামনের দুটো বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর দলের ভিতরে নানা গোষ্ঠী সক্রিয়। যে সমাজবিরোধীরা কমিউনিস্ট পার্টিকে পরিত্যাগ করে তাঁর দলে ভিড়েছিল, তারা এখন তাঁকে ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া শুরু করেছে। ২০০৪ সালে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেখান থেকে গত নির্বাচনে তার ১৭ শতাংশে পৌঁছনোর ঘটনায় বোঝা যায়, রাজ্যে এই দলটিই শাসক তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। বামপন্থীরা সাড়ে তিন বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, এখনও তা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি, বরং গত লোকসভা নির্বাচনে তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। তারা এখনও তৃণমূল এবং বিজেপির বিরোধী লড়াইয়ের কোনও কার্যকর রাজনৈতিক উপায় খুঁজে পায়নি। আর কংগ্রেস তো সাইডলাইনেই দাঁড়িয়ে।
শহরে যে মধ্যবিত্ত ভোটাররা দিদিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা হতাশ, কারণ তাঁরা এখন মনে করছেন যে, একটা ঠিকঠাক প্রশাসন চালানোর যোগ্যতা এই নেত্রীর নেই। ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীদের কাছে তাঁর নাটুকেপনারও আর কোনও আকর্ষণ নেই। তাঁরা আশা, গ্রামের মুসলিম ধর্মাবলম্বী কৃষিজীবী মানুষ তাঁর সঙ্গে থাকবেন। সেটা হয়তো ঠিকই। বিজেপিও এটা বুঝেছে এবং সেই কারণেই পুরোদস্তুর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দু এজেন্ডা নিয়ে প্রচার শুরু করেছে।
কলকাতায় অমিত শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে যে ভাবে যে সব মন্তব্য করেছেন, তাতে আরএসএসের ছায়া চিনে নিতে কোনও ভুল হয় না। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান, অনেক জায়গাতেই অনুপাতটা এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি। এই মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাগুলি বাদ দিয়ে অবশিষ্ট রাজ্যে বিজেপি স্পষ্টতই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ অনেক জোরদার করবে।
নরেন্দ্র মোদীর দিল্লি জয়ের কল্যাণে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা এখনও চলছে। এই আবেগে সওয়ার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের যে সব ‘জনপরিষেবা প্রতিষ্ঠান’ আদিবাসী এবং পিছিয়ে-থাকা নিম্নবর্ণের মানুষের উপর মনোনিবেশ করে, সেগুলির বিস্তার ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তারিক তাচিল বনবাসী কল্যাণ আশ্রম এবং সেবা ভারতী-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে খুব তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন: ‘বিজেপির প্রয়োজন দরিদ্রদের নিয়ে আসা এবং ধনীদের ধরে রাখা, এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পক্ষে বিশেষ উপযোগী হল জনপরিষেবা যার একটা আদর্শগত মাত্রাও যে নেই তা নয়।’ (লক্ষ করার ব্যাপার, সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামপন্থীরাও পশ্চিমবঙ্গে এ-রকমই একটা পথ নিয়েছিল।)
শেষ কথাটা ছোট এবং আশঙ্কার মেঘে ঢাকা। বাংলার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি, উভয়েরই রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূল। যার মা-বাবা কলকাতার রাস্তায় রক্তের স্রোত দেখেছেন, তেমন এক জন মানুষের পক্ষে দেওয়ালের লিখন আতঙ্কজনক। আশা করি, আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হবে।