চালাঘরে মাদুর বিছিেয় শুতে যাচ্ছেন সাংসদ

সে ঘরে বিদ্যুৎ-সংযোগও নেই। অরুণবাবুর যুক্তি, যতদিন না প্রতিটি মজুরের মাথায় ছাদ হচ্ছে, ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছচ্ছে, ততদিন এই সুবিধে তাঁরও প্রাপ্য নয়। লিখছেন পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা

কমরেড অরুণকুমার রায় চলে গেলেন গত রবিবার। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সোমবার ধানবাদে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল। একে রায় নামে তিনি লোকপ্রিয় ছিলেন। গত রবিবার ঝাড়খণ্ডে তাঁর মৃত্যুতে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের এক দীর্ঘ অধ্যায় থেেম গেল। সেই অধ্যায়কে ফিরে দেখতেই কলম ধরা।

১৯৩৫ সালে একে রায়ের জন্ম অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায়। বাবা শিবেশচন্দ্র রায়, মা রেনুকা রায়ের প্রধান পরিচয়, তাঁরা অগ্নিযুগের জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। শিবেশচন্দ্র রায় জীবিকা অর্জনের জন্যে ওকালতি করতেন। ১৯৬০ সালে রায় পরিবার দিনাজপুরে চলে আসেন। রায়গঞ্জ আদালতে নিয়মিত যেতেন তিনি। শিবেশচন্দ্র ও রেনুকাদেবীর সন্তান অরুণ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন রাজশাহীরই নওগাঁ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিবেশচন্দ্র স্কুলশিক্ষার জন্যে ছেলেকে বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করেন। সেখান থেকে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বিজ্ঞানে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম পাঠ। এর পরেই জার্মানিতে তিনি যান উচ্চশিক্ষারপাঠ নিতে।

অরুণবাবু দেশে ফিরে কলকাতায় প্রথমে একটি বেসরকারি সংস্থায় গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে ধানবাদের সিন্ধ্রিতে প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নেন বিজ্ঞানী ক্ষিতীশরঞ্জন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারি সার তৈরির কারখানা পিডিআইএল (প্রোজেক্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিয়া লিমিটেড)-এ। এই প্রথম মেহনতি মানুষের সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করার সুযোগ হল তাঁর। খুব অল্প দিনেই মজদুর মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন অরুণকুমার রায়। শ্রমিকের অনন্ত শোষণের ইতিহাস, বঞ্চনা একে রায়কে গভীর ভাবে নাড়িয়ে দিল। গরিব মজদুর ভাইদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেই অল্প কিছু দিনেই চাকরি ছাড়লেন তিনি। এই শুরু হল ২৪ ঘণ্টার শ্রমিক আন্দোলনের যাত্রাপথ রচনা। ৮৪ বছরের জীবনের অধিকাংশটাই এই সমর্পণেই কাটল।

প্রাথমিক ভাবে সিপিআই(এম)-এর সদস্য ছিলেন অরুণকুমার রায়। তার পরে তাঁর পথ চলা শুরু হয় মার্ক্সিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে। সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল তদানীন্তন অবিভক্ত বিহারে আদিবাসী মানুষদের অধিকারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। তাঁর মনে হয়েছিল তাঁদের আশা-আকাঙ্খার কথা দলের নীতিতে যথেষ্ঠ প্রতিফলিত হচ্ছে না। আমার মনে আছে, এ প্রসঙ্গে তিনি আমায় বলেছিলেন যে, এই ক্ষেত্রে অন্তত তিনি বিহারের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-এর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মনোভাবের মধ্যে কোনও পার্থক্যই দেখতে পান না। অরুণবাবুর এ ধরনের মন্তব্যে স্বাভাবিক ভাবেই সিপিআই(এম) নেতৃত্ব খুশি হননি। তবে শ্রমিক আন্দোলনের পরিসরে, এমসিসি-র ট্রেড ইউনিয়ন শাখা কোলিয়ারি কামগার ইউনিয়ন সিআইটিইউ-এর সঙ্গে বহু ইস্যুতেই একত্রে আন্দোলন করেছে।

অরুণবাবুর জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। লোকসভায় জনতার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিন বার, তিন বারের বিধায়কও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তিরিশ বছর জনতার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়া মুখের কথা নয়। একে রায়ের এই জনপ্রিয়তার কারণটা সহজেই অনুমেয়। লোকসভা হোক বা বিধানসভা, ভোটপ্রচারের খরচের বহর গোটা দেশের মানুষ আজ সহজেই অনুমান করতে পারেন। এই নির্বাচনে লড়ার অর্থবল একে রায়ের কখনও ছিল না। তাঁর ছিল জনবল, তাই দিয়েই লম্বা লড়াইয়ে জিতেছেন তিনি। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের শরিক হতে তিনি প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়েছেন, আর বিনিময়ে পেয়েছেন জনাদেশ, মানুষের নেতা হিসেবেই নির্বাচিত হয়েছেন বার বার। তাঁর জীবনযাত্রাও ছিল আশ্চর্য নিরাড়ম্বর। যখন সাংসদ ছিলেন, থাকতেন বিঠলভাই প্যাটেল হাউস নামে পরিচিত একটি বাড়িতে। সেটা সংসদ থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে ছিল। অরুণবাবু বরাবর বাড়ি থেকে সংসদে যেতেন হেঁটে, গাড়িতে নয়। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বসে তিনি চা খাচ্ছেন, এ অতি পরিচিত দৃশ্য ছিল আমাদের কাছে।

সাংসদ হিসেবে যে বেতন পেয়েছেন একে রায়, আজীবন তা কয়লাখাদানের শ্রমিক, দলের শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছেন একে রায়। অবসরের সময়ে যে পেনশন পেয়েছেন তাও দিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কোষাগারে। মাস ফুরোলে ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা বা বছরে ৩৪টি উড়ানের সুবিধে কখনও নেননি একে রায় কেননা তাঁর প্রতর্ক ছিল, একজন নেতা কখনও সেবার আদর্শচ্যুত হতে পারেন না, অতএব এই অর্থও মানুষের কাজেই লাগুক। যতদিন প্রতিটি মজুরের মাথায় ছাদ আর ঘরে বৈদ্যুতিক সুযোগ-সুবিধে পৌঁছচ্ছে না, ততদিন এই সুবিধে তাঁরও প্রাপ্য নয়, এই বিশ্বাসে একে রায়ের ৫০টা বছর কেটেছে বিদ্যুৎহীন পার্টি কার্যালয়েই। সম্পদ বলতে ছিল একটি ভাঙাচোরা স্কুটার। খাপরার চাল ছাওয়া ঘরে মেঝেতে মাদুর পেতে শুতে যাচ্ছেন তিন বারের সাংসদ, তিন বারের বিধায়ক, এই দৃশ্য ভারতের ইতিহাসে বিরল।

গোটা দেশ ধানবাদকে চেনে কয়লাখনির জন্যে। এটুকু বললে অবশ্য সবটা বলা হয় না। ‘কালাপাথর’ বা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর দৌলতে সকলেই জানেন এই অঞ্চলের কয়লা মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। একে রায়ের আজীবনের লড়াই ছিল এই কয়লামাফিয়াদের সঙ্গে। মজদুরের হকের টাকা যাতে সিকি আধুলি হিসেবে বুঝিয়ে দেয়, একটি পয়সাও যাতে মার না যায়, তা কার্যত কয়লামাফিয়াদেরও মানতে বাধ্য করেছিলেন একে রায়। আসলে তিনি ‘প্রাকৃতিক সম্পদের অভিশাপ’ তত্ত্বটিকে বুঝতে পেরেছিলেন। সারা জীবন অজস্র লেখনীতে সেই তত্ত্বের কথাই জানান দিয়ে এসেছেন। দেখিয়েছেন কী ভাবে তৃতীয় বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ভূমিপুত্রদের বিপন্ন করে তোলে আর বহিরাগতদের মুনাফা লুটের খনি হয়ে ওঠে প্রকৃতির এই আকরিক।

২০০০ সালে বিহার থেকে আলাদা হল ঝাড়খণ্ড। ঝাড়খণ্ড গঠনের প্রাণপুরুষ হিসেবে বারবার উঠে আসে বারবার শিবু সোরেনের নাম। শিবু সোরেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন, কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব সামলেছেন, অলক্ষ্যেই থেকে গিয়েছে ঝাড়খণ্ড গঠনে একে রায়ের লড়াই। যে ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চার পুরোভাগে ছিলেন সোরেন, তা একে রায়ের হাতেই তৈরি, সোরেন ছিলেন তাঁর সহযোগী। পার্থক্য এই কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দায়িত্ব, দিল্লির বাংলো, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর পদ, এ সবের মোহ একে রায়ের ছিল না। কাজেই এই কৃতিত্ব ঝেড়েই ফেলেছেন একে রায়।

উল্লেখ্য, বিধানসভা বা লোকসভায়, বিধায়ক অথবা সাংসদদের ভাতাবৃদ্ধির কথা উঠলেই দেখা যায় পক্ষ-বিপক্ষের সমস্ত বিভেদ মুছে গিয়েছে। সকলেই বিনাবাক্যে মেনে নিচ্ছেন ভাতাবৃদ্ধি। ভারতে ভবিষ্যতে যত বার এই বিধায়ক-সাংসদের ভাতাবৃদ্ধির অবকাশ আসবে, তত দিন একে রায়ের কথা স্মরণ করবেন অনেকে, তিনি ৫৪৩ জনের মধ্যে একা প্রহ্লাদ যিনি সাংসদদের বেতনবৃদ্ধি সমর্থন করেননি কখনও। এমনকী সাংসদদের সঙ্গী হিসেবে বিমানে বা ট্রেনে একজনের সরকারি অর্থে ভ্রমণের সুবিধা দেওয়ারও বিরোধী ছিলেন অরুণবাবু। তাঁর সাফ কথা ছিল--- সরকারি অর্থ তো আসলে মানুষের টাকা, তার অপচয়ের কোনও অধিকার সাংসদদের নেই।

সত্যে অবিচল থাকা ও আর সততার পথকে পাথেয় করার জেদ একে রায়কে সমসময়ের সকলের থেকে আলাদা করেছে। আজকের রাজনীতিতে আপোশের থেকে বড় সত্য কিছু নেই, ভোটপরবর্তী দেশের সংবাদ শিরোনাম দেখলেই তা বোঝা যায়। এই কঠিন সময়ে কি আমরা একে রায়ের থেকে প্রেরণা নেব না?

আজীবন অকৃতদার ছিলেন একে রায়। জিজ্ঞেস করলে হেসে বলতেন, সময় পাননি বিয়ে করার। ব্লাড প্রেশারের সমস্যা ছিল, রক্তে শর্করাও মাত্রা ছাড়িয়েছিল। দু’বার স্ট্রোক হওয়ার পরে স্থানীয় মানুষজনই তাঁর দেখাশোনা করতেন।

একে রায়ের আজীবনের সাধনা ছিল প্রান্তিক মানুষের মধ্যে থেকে কাজ করা, সমাজের সব থেকে অপারগকে হাত ধরে তুলে আনা। ঝরিয়া, ধানবাদের জ্বলতে থাকা খাদানগুলিতে কাজ করে যাওয়া আদিবাসীদের একজোট করেছিলেন একে রায়। ঝাড়খণ্ডে খোঁজ নিলে জানা যাবে এই শ্রমিক একতাই কয়লামাফিয়ার বন্দুকের নল নিষ্ক্রিয় করেছিল, আর শ্রমিককে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাঁর প্রাপ্যটুকু।

কমরেড একে রায়কে জানা, কাছ থেকে চেনা এক পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার আমার জীবনে। এমন লোক তামাম ভারতেই বিরল। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে পর্যাপ্ত শব্দ আমাদের ভাণ্ডারে নেই। তবু তাঁর কার্যকলাপের টুকরো কথা দেশের যুবসমাজকে জানিয়ে যেতে চাই আগামী দিনে বার বার। তাঁর জীবনকে পাথেয় করে যুবকেরা গরিব মানুষ আর শ্রমিকের অধিকারের জন্যে কাজ করছে, এই দিনটার স্বপ্নেই বাঁচা।

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
The Modi Myth