ভারত সরকার মুদ্রাস্ফীতি বোঝার জন্য দুই ধরনের সূচক ব্যবহার করে, একটি হলো হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স, বা পাইকারি মূল্য সূচক, অন্যটি হলো কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা উপভোক্তা মূল্য সূচক। পাইকারি মূল্য সূচকে দেখা যায়, যারা উৎপাদন করছে, তাদের খরচ কীভাবে বাড়ছে, অন্যদিকে উপভোক্তা মূল্য সূচক দেখায়, সাধারণের জীবনযাপন কীভাবে প্রভাবিত হয় মূল্যবৃদ্ধির ফলে। মানুষের আয়ের সঙ্গে যদি মুদ্রাস্ফীতির গতির সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে জীবনযাপনের মানদণ্ড পড়তে থাকে। ভারতে এটাই ঘটে চলেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। সাধারণভাবে বেঁচে থাকার যে খরচ, তা বাড়ছে, অথচ আয় বাড়ছে না, ফলে আমমানুষের যাপনের মান ধীরে ধীরে পড়ছে, সাধারণ নাগরিকের দুরবস্থা বাড়ছে ক্রমশ।
পনেরো মাস যাবৎ প্রত্যেক মাসে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে দশ শতাংশ করে, এর আগে কখনও যা ঘটেনি। ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য থেকেই এই পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। পাইকারি মূল্য সূচক মে মাসে হয়েছে ১৫.৮ শতাংশ। আমি বলব, বিগত তিরিশ বছরে ভারতের এই অবস্থা হয়নি। একথা ঠিক যে, বিশ্বজুড়েই অবস্থা এরকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে লাগাতার। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, তাদের কাছে বাস্তব হলো, জিনিসপত্রের দাম অহরহ বাড়ছে, এবং তার ফলে তার জীবনধারণ কঠিন হয়ে উঠছে। এখানে অন্য কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের পরিস্থিতির তুলনা অবান্তর।
কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে? কারণ তেলের দাম বাড়ছে। তেলের দাম প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেড়েছে মে মাসে। ভারতে যে কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তার নব্বই শতাংশ আমদানি হয়। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধর পর তেলের দাম বেড়েছে তীব্র গতিতে। অন্যদিকে, ২২ মে ভারত সরকার ডিজেল এবং পেট্রোলের ওপর যে উৎপাদন শুল্ক বসে, তা কমিয়ে দিয়েছে। কিছুটা দাম পড়েছে তেলের। কিন্তু তেলের দাম যে গতিতে বাড়ছিল, তা এমনকী এই সরকারকেও, যারা কিনা গরিবের কথা তত ভাবে না, তাদেরকেও চিন্তায় ফেলেছিল। আমাদের দেশে সরকারি তেলের কোম্পানিগুলির অবস্থা সঙ্গিন। কারণ, উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন চলাকালীন পাঁচ মাস তেলের দাম বাড়ায়নি তারা। কেন বাড়ায়নি, তার উত্তরও সহজ। কারণ, সরকার তাদের বাড়াতে দেয়নি। নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর, এবং তার ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর, আবার সেই দাম বাড়তে থাকল। এমনকী, দাম বাড়ল গ্যাস সিলিন্ডারেরও। যখন ডিজেলের দাম বাড়ে, তখন অন্য অনেককিছুর ওপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।
অন্যদিকে উপভোক্তা মূল্য সূচক কখনওই দুই থেকে ছয় শতাংশের বেশি বাড়া উচিত নয়। কিন্তু গত ছ'মাস প্রতি মাসে এই সূচক সাত শতাংশের ওপর বাড়ছে, লাগাতার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বারবার এই সূচক কমার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু অবস্থা থেকে গেছে তথৈবচ। আর এই সূচক কমলেও জিনিসপত্রের দাম আদতে কমছে না, বাড়ছে। শুধু যে গতিতে বাড়ছিল, তার থেকে কম গতিতে বাড়ছে।
গম, মুসুরির ডাল, মুগ ডাল, খাবার তেল, বিভিন্ন ধরনের সবজি, পেঁয়াজ, টমেটো, আলুর মতো দৈনন্দিন পণ্যর দাম বাড়ছে। এর ফলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়ছে দেশের গরিব মানুষ। কারণ তাদের আয়ের অনেকাংশ খরচ হয় খাবারের জন্য। ফলে, গরিবের অবস্থা ঠেকছে তলানিতে। একইসঙ্গে বেড়ে চলেছে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তর মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যর মাত্রা। আজ ভারতে এই দুই শ্রেণির মধ্যে যে ব্যবধান, তা নজিরবিহীন। বিভিন্ন প্রতিবেদন, সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এই বৈষম্যের সূচকে ভারত বিশ্বের মধ্যে প্রায় শীর্ষে রয়েছে। তার সঙ্গে জুড়ছে যুবসমাজের বেকারত্বর সমস্যা ও রোজগারের অভাব। ফলে, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বসাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। আজ ভারতের সাধারণ মানুষ কীভাবে বাঁচছে, ভারত সরকারের নথিই তার প্রমাণ দিচ্ছে।