আদানির নিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল নদদ্ধেি মহুয়া?

ধমরা এলএনজি টার্মিনাল নিয়ে ফের সংসদে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। চলতি বছরের মার্চ মাসে। টার্মিনালের ক্যাপাসিটি ব্যবহারের জন্য আইওসিএল এবং গেইলকে কোনও রকম আর্থিক মূল্য চোকাতে হয় কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করেন মহুয়া। এ ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি ধরমা টার্মিনালের সঙ্গে কী কী চুক্তি করেছে তা নির্দিষ্ট করে জানতে চান তৃণমূল সাংসদ।

এর আগেই বলেছি মহুয়ার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড আইনজীবী অনন্ত দেহাদরাই সিবিআই-এর কাছে বেশ কিছু নথি তুলে দেন। নথিতে আইনজীবীর অভিযোগ, 'ধরমা এলএনজি টার্মিনাল নিয়ে মহুয়ার এত প্রশ্ন করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। কেননা বঙ্গোপসাগরের ওই পূর্ব উপকূল বরাবর গ্যাস পাইপলাইন বসাতে দরপত্র জমা দেওয়ার কথা ভেবেছে আদানির প্রতিপক্ষ হিরানন্দানি গোষ্ঠী।'

আদানিকে মহুয়ার আরও যে সব প্রশ্ন

আদানি সংক্রান্ত আরও চারটি প্রশ্ন মহুয়া মৈত্র করেছেন।
১। অন্ধ্রের গঙ্গাভরম বন্দর ২। ছত্তীসগঢ়ের কয়লাখনির নতুন করে বণ্টন ৩। আদানি গোষ্ঠীর বৈদেশিক বিনিয়োগ ৪। সরকার নিয়ন্ত্রিত ছ'টি বিমানবন্দর আদানি গোষ্ঠীকে হস্তান্তর।

২০২১ সালে আদানি গোষ্ঠীর একাধিক বৈদেশিক পোর্টফোলিয়ো বিনিয়োগ নিয়ে বিশদে প্রশ্ন তোলেন মহুয়া। প্রশ্ন তোলেন, এ ধরনের সংস্থাগুলি যার সঙ্গে আদানি গোষ্ঠী জড়িয়ে, তাদের সন্দেহজনক লেনদেন কেন্দ্রের এজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেট বা ইডি তদন্ত করে দেখে কি না? সেবি খতিয়ে দেখে কি না? তদন্ত হয়ে থাকলে তা থেকে কী রিপোর্ট বেরিয়ে এসেছে? তাও বিশদে জানতে প্রশ্ন তোলেন মহুয়া।

আরও পড়ুন: টাকার বিনিময়ে আদানি-দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন! মহুয়া বিতর্কে কেন চুপ তৃণমূল?

আদানি বন্দর অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন লিমিটেড এবং ইন্ডিয়াল অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডের মধ্যে গঙ্গাভরম বন্দর সংক্রান্ত বিস্তারিত কী চুক্তি হয় তা নিয়ে বিশদে তথ্য জানতে প্ৰশ্ন তোলেন তৃণমূল সাংসদ। ওই ২০২১ সালেই মহুয়ার প্রশ্ন, আদানি গোষ্ঠীকে দেশের ছয় বিমানবন্দর হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে। গুজরাটের আমেদাবাদ, উত্তর প্রদেশের লখনউ, রাজস্থানের জয়পুর, অসমের গুয়াহাটি, কর্নাটকের মেঙ্গালুরু এবং কেরলের তিরুঅনন্তপুরম। এই ছয় বিমানবন্দর অধিগ্রহণ করতে আদানির সংস্থার কেন দেরি হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন করেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

২০২৩-এর এপ্রিল। কেন্দ্রের কয়লা মন্ত্রকের সামনে ছত্তীসগঢ়ের কয়লাখনির পুনর্বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন করেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। পরসা পূর্ব এবং কেটে বাসান কয়লাব্লক আদানি গোষ্ঠীকে পুনর্বণ্টন এবং সেই বণ্টনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট দেশের ২১৪ কয়লাব্লকের বণ্টন অবৈধ ঘোষণা করে নতুন করে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দরপত্র হাঁকার নির্দেশ দেয়। মহুয়ার অভিযোগ, সেই নির্দেশকে অগ্রাহ্য করেই ছত্তীসগঢ়ের কয়লাখনির পুনর্বন্টন করে কেন্দ্রের মোদি সরকার। মহুয়ার অভিযোগের এক মাস আগেই আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই একই অভিযোগ আনে জাতীয় কংগ্রেস।

মহুয়ার পাশে রাহুলের কংগ্রেস

কয়লাখনি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৫-এর ১১(ক) ধারার প্রসঙ্গ টেনে এনে কংগ্রেস কয়লাব্লক পুনর্বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। বলা হয়, ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে পরেই এই আইনে বদল আনে তৎকালীন মোদি সরকার। একইসঙ্গে কংগ্রেস দাবি করে, ওই ধারার কিছু ফাঁকফোকরের কারণেই আদানির গোষ্ঠীর হাতে কয়লাব্লকের পুনর্বণ্টন করে মন্ত্রক। আদানি গোষ্ঠী খনির ডেভেলপার এবং পরিচালক হিসেবে নতুন করে বরাত পায়। এক ধরনের চুক্তিভিত্তিক কয়লা উত্তোলনের ছাড়পত্র পায়। পারসা পূর্ব এবং কাটে বাসান কয়লাখনি। যে খনি এক সময়ে বিজেপি শাসিত রাজ্য রাজস্থান এবং গুজরাট দ্বারা পরিচালিত হত।

মহুয়া মৈত্রের সংকটের সময় পাশে দাঁড়ায় কংগ্রেস। বিতর্কে মুখ খোলেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী। মহুয়া বিতর্কে মোদি সরকার ছোট ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিরাট করে দেখানোর চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন অধীর। মহুয়ার ঘটনার সঙ্গে তিনি রাহুল গান্ধিরও তুলনা টেনে আনেন। আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করায় রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ যেভাবে কেড়ে নেওয়া হয় সে প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করেন অধীর। যদিও রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের জন্য গুজরাট আদালতের রায়কেই কারণ হিসেবে দেখায় কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর পদবি নিয়ে অসম্মানসূচক মন্তব্যের অভিযোগে বিজেপি শাসিত গুজরাটের আদালত রাহুলকে দোষী সাব্যস্ত করে।

অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, 'জানি না ঠিক কী ঘটেছে। কিন্তু সাধারণভাবে একজন সাংসদের অধিকার রয়েছে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করার। শাসক দল সংসদের ভিতরে হোক বাইরে হোক প্রত্যেকের কণ্ঠরোধ করতে চায়।'

আরও পড়ুন: সব অভিযোগ মনগড়া! উপহারের বিনিময়ে প্রশ্ন বিতর্কে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন মহুয়া?

মহুয়া মৈত্রের নিজের দল অবশ্য ঘুষ নিয়ে প্রশ্ন বিতর্কে সেই অর্থে সরব হয়নি। সম্ভবত এথিক্স কমিটির রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি দলের নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আদানি পরিচালিত এনডিটিভি চ্যানেলের ওয়েবসাইটে একজন কলাম লেখক কেন তৃণমূল কংগ্রেস এ নিয়ে চুপ তার কিছু সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। মহুয়ার অভিযোগ, বিজেপির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সব বিতর্কের মধ্যে টেনে এনে যে কোনও উপায়ে তাঁর সাংসদ পদ বাতিল করা। যাতে তাঁকে সংসদের বাইরে রাখা যায়। যাতে মহুয়া আদানির বিরুদ্ধে সংসদে আর প্রশ্ন করতে না পারেন।

নিশিকান্ত দুবের অভিযোগপত্র পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে লোকসভার অধ্যক্ষ বিষয়টি পাঠিয়ে দেন এথিক্স কমিটিতে। এথিক্স কমিটি হচ্ছে সংসদের ভিতরের একটি প্যানেল যা সাংসদদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, বা কোনও বেনিয়ম খতিয়ে দেখে। লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল, বিশ্লেষক পি ডি টি আচারির মতে, কোনও সাংসদদের বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগ যদি সত্যিই খতিয়ে দেখতে হয় তো এথিক্স কমিটি নয়, বিষয়টি প্রিভিলেজ কমিটিতে পাঠানো জরুরি ছিল। এই বিতর্কের মধ্য়েই ২৬ অক্টোবর এথিক্স কমিটি নিশিকান্ত দুবে এবং অনন্ত দেহাদরাইয়ের সঙ্গে কথা বলে। ৩১ অক্টোবর মহুয়া মৈত্রের হাজিরা দেওয়ার কথা। মহুয়া যদিও চিঠি লিখে ওই দিন হাজিরা দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

কাহিনির ফোকাসে ফের হিরানন্দানি

সংসদের এথিক্স কমিটির কাছে দর্শন হিরানন্দানি তাঁর হলফনামা জমা দিয়েছেন। মহুয়ার মৈত্রের প্রশ্ন হিরানন্দানির ওই হলফনামা কী ভাবে মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে গেল? হিরানন্দানি প্রথম দিকে 'বন্ধু' মহুয়ার দিকেই ছিলেন। পরে সম্ভবত তাঁর মনোভাব বদলেছেন। অন্য রাস্তা ধরেছেন। হলফনামায় হিরানন্দানি দাবি করেন, মহুয়া মৈত্র তাঁর সংসদীয় ইমেল লগ-ইন এবং পাসওয়ার্ড শেয়ার করেছেন। মহুয়ার হয়ে তিনি পোর্টালে লগ-ইন করে প্রশ্ন করেছেন।

হলফনামা সূত্র ধরেই পালটা অভিযোগ করেন তৃণমূল সাংসদ। মহুয়ার অভিযোগ, 'দর্শন হিরানন্দানিকে ভয় দেখিয়ে জোর করে হলফনামায় সই করানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর তার 'কুখ্যাত বন্দুক' দর্শন এবং তাঁর বাবার মাথায় ঠেকিয়ে মাত্র কুড়ি মিনিট সময় দেয়। ওই সময়ের মধ্যে হলফনামায় সই করে ফেরত দিতে বলে।'

মহুয়ার এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগের পরেই তাকে বিবৃতি দিয়েছেন হিরানন্দানি। লোকসভার দেওয়া লগ-ইন আইডি এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে তিনি নিয়মের প্রতি সুবিচার করেননি। একইসঙ্গে হিরানন্দানির দাবি, তিনি দুবাই থেকে হলফনামা জমা দিয়েছেন। কোনও রকম চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বা কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিতে তিনি এই হলফনামা দেননি।

এরইমধ্যে দিল্লি হাইকোর্টে একটি সম্মানহানির মামলা দায়ের করেন মহুয়া। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং তাঁর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড আইনজীবী জয় দেহাদরাইয়ের বিরুদ্ধে ওই মামলা করা হয়। মামলায় যুক্ত করা হয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলকেও। লোকসভার অধ্যক্ষকে জমা করা চিঠির নথি এবং তার বিষয়বস্তু চ্যানেলটি সম্প্রচার করে। মহুয়া একইসঙ্গে অভিযোগ করেন, যে তার ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফ এডিট করে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মহুয়া মৈত্রের সমর্থনে ব্যাট ধরেন তিরুঅনন্তপুরমের সাংসদ শশী থারুর। শশীর বক্তব্য, 'নিশিকান্ত দুবের লোকজন এবং বিজেপি নোংরা, সস্তার রাজনীতি করছে। মহুয়ার জন্মদিনে তোলা ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে।' এরকমই এক ছবিতে দেখা যায় শশী থারুর তাঁর বোন এবং মহুয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু ছবি এডিট করে ক্রপ করে শশীর বোনকে ফ্রেম থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেই ছবি সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এরইমধ্যে তাঁর মহুয়া তাঁর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড জয় দেহাদরাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিসে অভিযোগ দায়ের করেন। পোষ্য রট উইলারের হেফাজত নিয়ে পুলিসে অভিযোগ করেন সাংসদ। পরে অবশ্য পোষ্যকে ফেরত পেয়ে তিনি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন।

আরও পড়ুন: দেশদ্রোহীর তকমা পরঞ্জয়, অভিসারদের? আসলে ঠিক কী লিখতেন এই সাংবাদিকরা?

কাহিনি আরও জটিল হয় যখন মহুয়ার আইনজীবী গোপালা শংকরনারায়ণা নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নেন। দিল্লি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে তিরস্কার এবং সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মহুয়ার আইনজীবী গোপালাকে। অভিযোগ ওঠে, গোপালা আদালতের বাইরে জয় দেহাদরাইয়ের সঙ্গে মামলার সমঝোতা সেরে ফেলতে চেয়েছেন। অভিযোগ ওঠে, সমঝোতার র্শত ছিল, দেহাদরাইকে পোষ্য রট উইলারের হেফাজত দেওয়া হবে, বদলে মহুয়ার বিরুদ্ধে সিবিআই-এর কাছে জমা করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন তাঁর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড।

যাই হোক মহুয়া মৈত্রের উপর লাগাতার আক্রমণ হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে কুরুচিকর প্রচার চলছে এতে বিষ্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই প্রতিবেদনের এক লেখক (পরঞ্জয়) মোবাইলের সিগন্যাল অ্যাপে একটি অচেনা নম্বরের টেক্সট পান। সেখানে মহুয়ার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। হোয়াটস গ্রুপেও মহুয়ার ব্য়ক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা-গসিপ এসব চলতেই থাকে।

এই বিতর্কের জেরে মহুয়ার সাংসদ পদ যদি বাতিল হয়ে যায় তা হলে খুব কম লোকজনই বিষ্মিত হবেন। যেমন রাহুল গান্ধির হয়েছিল। কিন্তু এটা ঠিক যে ইদানিং কালে কোনও মহিলা সাংসদের বিরুদ্ধে এ রকম কুরুচিপূর্ণ, নোংরা প্রচার হয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে আনা হয়নি। একজন মহিলা যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং আদানির বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট মত জানিয়েছেন। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছেন।

কাহিনির এখানেই শেষ নয়।

Featured Book: As Author
Divided We Stand
India in a Time of Coalitions
 
Featured Book: As Publisher
Chasing His Father's Dreams
Inside Story of Odisha's Longest Serving Chief Minister