মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিজেপি ফিরে এসেছে। অনেকেই বিস্মিত এই ঘটনায়। এই বিধানসভা ভোটের সঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের সম্পর্ক বা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের সম্পর্ক অবশ্যই আছে। তবে, বিষয়টা জটিল। কংগ্রেসের এখন নানা দুর্বলতা। প্রথমত, ভারতীয় জনতা পার্টির যে আগ্রাসী হিন্দুত্ব, কট্টর হিন্দুত্ব, তার বিরুদ্ধে নরম হিন্দুত্ব আশ্রয় করলে হার অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই ভুল ভূপেশ বাগেল করেছিলেন। বলেছিলেন, অযোধ্যায় রামমন্দির হচ্ছে, তাঁর রাজ্যও নাকি একদা রাম বাস করেছেন। কমলনাথও সেই একই ভুল করলেন। কেবল মন্দিরে মন্দিরে ঘুরলেন। কাজ হল?
দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে বড় পুঁজিপতিদের যে জোট, আদানি-আম্বানি জোট, এটাও তো মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। রাহুল গান্ধী যতই সমালোচনা করুন, কমলনাথ কি আদানির বিরুদ্ধে একটাও কথা বলেছেন? বলেননি ভূপেশ বাগেলও। বলতে শুরু করলেন এই কয়েকদিন আগে। রাজীব গান্ধীকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার আদানি নিয়ে এত অভিযোগ, অথচ আপনারই দলের একজন প্রতিনিধি, অশোক গেলট, যিনি ঘটনাচক্রে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীও, তাঁকে তো আদানির সঙ্গে একই মঞ্চে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। কী বলবেন? রাহুল গান্ধী জবাব দিয়েছিলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তো একটা দায়বদ্ধতা থাকেই। কোনও বড় পুঁজিপতি যদি আমার রাজ্যে পঞ্চাশ হাজার কী ষাট হাজার কোটি টাকা লগ্নি করতে চান, লক্ষ লক্ষ যুবককে চাকরি দিতে চান, তাকে কি মুখ্যমন্ত্রী বারণ করতে পারবেন? এর বেশি কিছু বলতেই পারলেন না!
আসি ইন্ডিয়া জোটের প্রসঙ্গে। কমলনাথকে বলা হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদব কয়েকটাই মাত্র আসন চাইছেন। তিনি কী বললেন? না, এই অখিলেশ টখিলেশ আবার কে? এই অহংকার, এটিও কংগ্রসকে অনেকখানি দুর্বল করেছে। ইন্ডিয়া জোট কিছু কিছু সঞ্চালককে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই বাতিলের তালিকায় নাভিকা কুমারেরও নাম ছিল। অথচ কমলনাথ দিব্যি তাঁকে সাক্ষাৎকার দিয়ে ফেললেন! কোন যুক্তিতে? না, জোটের বয়কট লোকসভার জন্য, তিনি বিধানসভায় লড়ছেন। ফলে, কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও পরিষ্কার হল। এদিকে কমলনাথ দিগ্বিজয় সিং-এর সঙ্গে লড়ছেন, ওদিকে ভূপেশ বাগেল টি এস সিং দেও-এর সঙ্গে লড়ছেন! রাজস্থানে লড়ছেন শচীন পাইলট এবং অশোক গেহলট। এর একটা অবশ্যম্ভাবী প্রভাব রয়েছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব সব দলের ভিতরেই থাকে। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রধান বিরোধী দলের নেতারা যখন প্রকাশ্যে লড়াই করেন, তখন তাঁদের অবস্থানটাই আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
যেমন, একদিকে রাহুল গান্ধী চাইছেন জাতগণনা। অথচ তা নিয়ে কংগ্রেসের নিচের স্তরে কোনো টু শব্দটি নেই। কেন? বিহারে লালুপ্রসাদ হোন, নীতীশ হোন, বা তেজস্বী, জাতগনণাকে নির্বাচনী প্রচারের একটা অন্যতম বিষয় করতে পেরেছেন প্রত্যেকেই। কংগ্রেস পারেনি। এমনকি ছত্তিশগড়ে আদিবাসীরাও বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। মোদীর প্রতিশ্রুতি, আগামী পাঁচ বছর তাঁদের গম, চাল, ছোলা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেবেন। শিবরাজ সিং চৌহান ওরফে মামাজি, আঠেরো বছর মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি মাত্র কয়েকদিন আগেই মহিলাদের জন্য যোজনা শুরু করলেন। প্রত্যেক মহিলাই তাতে হাতে কিছু পাচ্ছেন। এরই সুফল বিজেপি পেয়েছে নির্বাচনে।
কংগ্রেস যতই বিজেপিকে গালমন্দ করুক, বিজেপি যেভাবে নির্বাচন লড়েছে, কংগ্রেস পারেনি। বারংবার তাদের এই হারের কারণ তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। এই সত্য অস্বীকারের জায়গা নেই। আর এস এস-এর সাংগঠনিক যে শক্তি রয়েছে, কংগ্রেসের তা একেবারেই নেই। গ্রামে গ্রামে আদিবাসী, তফশিলি জাতি, ওবিসি-রা সিংহভাগ বিজেপি ভোট দিচ্ছে। কেন? খতিয়ে দেখতে হবে না? রাজস্থানে না হয় একটা প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আবহাওয়া রয়েছে। অশোক গেহলটের নানা সেবামূলক যোজনাও খুব একটা হালে পানি পায়নি তাই।
অথচ আমরা যদি প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য দেখি, এক মধ্যপ্রদেশের আট শতাংশ ছাড়া, পার্থক্য কিন্তু খুব বেশি না। বাকি রাজ্যগুলোতে চার শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে মাঠে এখনও কংগ্রেস কিন্তু রয়েছে। তবু নির্বাচনে তারা বারবার হেরে যাচ্ছে কেন? রাহুল গান্ধীর সবথেকে বড় দুর্বলতা তাঁর দলেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব। তবে উপায়? আমি বলব, আরেকবার 'ভারত জোড়ো' যাত্রা করুন। কোহিমা থেকে কচ্ছ যাত্রা করুন। এতে কংগ্রেসের দুর্বলতা বাড়বে না। লাভ কতটা হবে সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই চোখে পড়বে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে বিজেপি কোত্থাও নেই। যদিও তেলেঙ্গানায় ওরা কয়েকটা আসন পেয়েছে, ভালোই ফল করেছে সেখানে। বেশ কিছু লোক বিজেপিতে চলেও যেতে পারেন। জগন রেড্ডি, চন্দ্রবাবু নাইডু, নবীন পট্টনায়েক, এমনকি কেসিআর-ও দরকার হলে বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। তারপরেও, দক্ষিণ ভারতে বিজেপি নেই বললেই চলে। আর উত্তর ভারতের হিমাচল, দিল্লি, পাঞ্জাব ইত্যাদি কয়েকটি জায়গা বাদে প্রায় সর্বত্র বিজেপি ছেয়ে গিয়েছে।
কংগ্রেস যদি না আত্মসমীক্ষা না করে, কেন তারা দুর্বল, কেন বিজেপির সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না নির্বাচনে—এই নিয়ে যদি চর্চা না করে, তবে আখেরে কাজের কাজ কিছুই হবে না। শুধু তা নিয়ে চিন্তা করে বা বিজেপির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে নয়, বিজেপির বিচারধারাটা কী, সেখানে নিজেদের মৌলিকতার জায়গাটা কোনটা, বুঝতে হবে। হিন্দুত্বের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বেছে নিতে হবে। ভূপেশ বাগেল গত পাঁচ বছরে খ্রিস্টানদের উপর যা অত্যাচার করেছেন, গত পনেরো বছরে রমেন সিং-এর আমলে তা হয়নি। তবে খ্রিস্টানরা কেন কংগ্রেসকে ভোট দেবেন? এর উত্তর খোঁজাটা জরুরি। আজ ভারতের যাবতীয় গণমাধ্যম, এমনকী ইডি সিবিআই-এর মতো সংস্থাও বিজেপির পাশে রয়েছে। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে যদি ইন্ডিয়া জোট দানা না বাঁধতে পারে, কমলনাথের মতো নেতা অখিলেশকে নিয়ে এ ধরনের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন, তবে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মনে রাখা দরকার, ২০১৯-এ প্রায় পঞ্চান্ন শতাংশ ভোট কিন্তু বিজেপিতে পড়েনি। অথচ এই বিপুল পরিমাণ বিরোধীরা একজোট নন। সবাই নিজের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। জোটবদ্ধ হতে পারলে খুব সহজেই বিজেপিকে হারানো যেত।
আগামী নির্বাচনের ফল কী হবে কেউই জানে না। তবে বিজেপির ভোট বাড়লেও বাড়তে পারে। কারণ ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদঘাটন হবে। এই নিয়েও কংগ্রেস সমালোচনা করবে। তাতে লাভ হবে কি? আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কট্টর হিন্দুত্বর বিরুদ্ধে নরম হিন্দুত্ব কোনওদিন লড়তে পারে না। বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের যোগাযোগ যদি মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় কংগ্রেস, তাহলে নির্বাচনে অবধারিত হারতে হবে। আজকে রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশেও এই দুরবস্থা সেই কারণেই। চন্দ্রশেখর রাও অত সমাজকল্যাণমূলক যোজনা সত্ত্বেও হেরে গেলেন। কেন? কারণ, ওখানকার সাধারণ ভোটাররা পরিবর্তন চেয়েছে। এই জমিটা তৈরি করতে হবে কংগ্রেসকে। একেবারে নিচুস্তরে সাধারণ মানুষদের বিকল্প একটা পথের সন্ধান দিতে হবে। বিজেপির নকল করে সস্তায় বাজিমাত করা যাবে না। জেতা যাবে না শুধু সমালোচনা করেও।