ইলেক্টোরাল বন্ড: দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিলম্বিত জয়

ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ওই বন্ডকে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক বলে জানিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। সামনেই ভোট। এই সময়ে সুপ্রিম কোর্টে এই রায় আমাদের ঠেলে দিয়েছে গতানুগতিক দুটি ভাবনার দিকে। ইংরেজিতে যাকে বলে 'ক্লিশে'। একদিক থেকে দেখতে গেলে এই রায় আসতে সত্যিই খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। তবে আবার এটাও তো ঠিক, দেরি হলেও তো হয়েছে।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি তাঁর বাজেট বক্তৃতায় প্রথম ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রস্তাব এনেছিলেন। তবে তা কার্যকর করতে আরও এগারো মাস সময় লেগে গিয়েছিল সরকারের। সে সময়ই কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছিল এই প্রকল্প। তাই সে সময়ই অর্থবিল হিসেবে পেশ করা হয়েছিল ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকে। যা আদতে রাজ্যসভায় পাস করতে হয় না। ইলেক্টোরাল রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আজকের এই যে সিদ্ধান্ত, সেখানে পৌঁছতে অন্তত ৬ বছর সময় লেগেছে। যার শুরুটা হয়েছিল প্রাথমিক ভাবে কমন কজ (CC) এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (ADR)-র হাত ধরে।

জেটলি বলেছিলেন, এই ইলেক্টোরাল বন্ড দেশের রাজনৈতিক অনুদানের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা আনবে। কিন্তু আসলে ঘটেছিল ঠিক উল্টোটাই। রাজনৈতিক অনুদানের ব্যাপারটিকেই আরও অস্বচ্ছ করে তুলেছিল এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প। ইলেক্টোরাল বন্ড যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী তহবিলকে অস্বচ্ছ করে তুলেছিল তা-ই নয়, কর্পোরেট অনুদানকারীদের অনুদানের নির্দিষ্ট সীমা সরে যাওয়ার ফলে ভারতীয় নির্বাচনে আর্থিক সহায়তাকারী বিদেশি শক্তি ও লবিস্টদের কাছে দুর্নীতির একটা বড় দরজাও খুলে দিয়েছিল এই প্রকল্প। গভর্নিং কাউন্সিল অব কমন কজের সদস্য এবং ADR-র সঙ্গে দুই মূল আবেদনকারীর একজন হিসেবে কমন কজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করতে পেরেছি বলে আমি গর্বিত। অর্থ বিলের অংশ হিসেবে অবৈধ ভাবে আনা হয়েছিল এই ইলেক্টোরাল বন্ডের সংশোধনী। যাতে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের স্ক্রুটিনির পদ্ধতিকে এড়ানো যায়। সুপ্রিম কোর্টের কাছে তা বাতিল করার আবেদন জানিয়েই জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন আবেদনকারীরা।

২০১৬ সালের ফাইন্যান্স অ্যাক্ট অনুযায়ী, বিদেশি সংস্থাগুলি যাদের ভারতে সহায়ক সংস্থা রয়েছে, তারা রাজনৈতির দলগুলিকে অনুদান দিতে পারে। যার ফলে ভারতের কর্পোরেট লবিস্টদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। এর আগে নিয়ম ছিল, কোনও সংস্থার রাজনৈতিক অনুদান তাদের তিন বছরের নিট মুনাফার ৭.৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে নতুন এই প্রকল্প আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই নিয়মকানুন একেবারে ধুয়েমুছে গেল। ফলে এখন ব্যবসায়িক ভাবে লোকসান করা সংস্থাগুলোও তাদের পছন্দসই রাজনৈতিক দলকে আর্থিক অনুদান দিতে পারছে। এমনকী তাঁদের ব্যবসায়িক মূলধন কিংবা সংরক্ষিত অর্থ থেকেও।

অবসরপ্রাপ্ত কমোডার লোকেশ বাটরা সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্নের ভিত্তিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, মোট ১৬,৫১৮,১০৯৯ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কেনা হয়েছে। এক কোটি টাকার বন্ডের হিসেবে অন্তত ১৫,৬৩১ কোটি টাকার বন্ড কেনা হয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ বলে জানা গিয়েছে।

দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ৬,৫৬৬,১২৫ কোটি টাকা এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র কাছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কাছে এসেছে ১,১২৩,৩১৫৫ কোটি টাকা। যা দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের মধ্যে ঘোষিত মোট ইলেক্টোরাল বন্ডের অর্ধেকেরও বেশি (৫৪.৭৭৮৬%) গিয়েছে বিজেপির কাছে। ইলেকশন কমিশন অব ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে রাজনৈতিক দলগুলোর অডিট রিপোর্ট পাওয়া যায়নি বলে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে প্রাপ্ত ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য সম্পর্কে বিশদে জানা যায়নি। তবে বন্ড থেকে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণই যে বেশি, তাতে সংশয় নেই। তবে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, তা হল ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি ভগ্নাংশ, যা রাজনৈতিক দল ও তার প্রার্থীরা আইনি বা বেআইনি ভাবে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করে।

এখন ধরা যাক, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ভারতের নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্র সরকার, সকলেই সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলল। তাতেও সাধারণ নির্বাচনের নির্ঘণ্ট জানতে জানতে মার্চের শেষ। ফলে আসন্ন ভোটের জন্য নির্ধারিত রাজনৈতিক তহবিলের উপর এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সামান্য পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

তার পরেও সুপ্রিম কোর্টের এই ১৫ ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানালেই নয়। ভবিষ্যতে কী হবে বলা কঠিন, তবে আমরা এটুকু আশা করতেই পারি যে নরেন্দ্র মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বাতিল বা সিদ্ধান্ত বদলের জন্য অধ্যাদেশ জারির মতো পথ বেছে নেবে না। পাশাপাশি এটাও আশা যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ জনেরও বেশি বিচারপতি দ্বারা গঠিত বৃহত্তম বেঞ্চের সিদ্ধান্তের সামনে রিভিউ পিটিশন বা কিউরেটিভ পিটিশনও দায়ের করবে কেন্দ্রীয় সরকার।