ইউএপিএ অস্ত্রে রাষ্ট্রের হাতে খুন হয়েছেন জি এন সাইবাবা

গোকারকোন্ডা নাগা সাইবাবা। ১৯৬৭ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্ব গোদাবরী জেলার আমলাপুরমের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম। জন্মের সঠিক তারিখ জানা যায় না, কারণ তাঁর বাবা মা জন্মতারিখ নথিবদ্ধই করেননি। পিত্তথলি থেকে পাথর বের করার অস্ত্রোপচারের পরে, অপারেশন পরবর্তী জটিলতার কারণে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে হায়দরাবাদে মারা গেলেন জি এন সাইবাবা, ২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর।

পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার পর, পাঁচ বছর বয়স থেকেই হুইলচেয়ার বন্দি সাইবাবা। মেধাবী পড়ুয়া সাইবাবা অমলাপুরমের শ্রী কোনাসিমা ভানোজি রামার্স (SKBR) কলেজের স্নাতকে সেরা ছাত্র ছিলেন। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর এবং তারপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে পিএইচডি করেন তিনি। তাঁর ডক্টরেট থিসিস ছিল "ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ অ্যান্ড নেশন মেকিং: রিডিং দ্য ডিসিপ্লিন"। সাইবাবা তেলগু এবং ইংরেজিতেও লিখতেন। লেখায় হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত দলিত ও আদিবাসীদের জীবন নিয়েই আলোচনা করে গিয়েছেন সাইবাবা।

নিষিদ্ধ মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে ভারত সরকার তাঁকে ২০১৪ সালে গ্রেফতার করে প্রথম। বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের (বা ইউএপিএ) অধীনে এই অভিযোগে ২০১৭ সালে একটি দায়রা আদালত সাইবাবাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। নাগপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয় অধ্যাপককে। মহারাষ্ট্র এবং তৎকালীন অবিভক্ত রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ এবং অমিত শাহের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থা গ্রেফতার করেছিল সাইবাবাকে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তিনি পড়াতেন, সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে সাইবাবাকে গ্রেফতার করা হয়।

আরও পড়ুন- সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের, তাও কেন বিনা বিচারে ৪ বছর বন্দি উমর খালিদ?

ইউএপিএ-কে ভারতীয় সমস্ত আইনের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর আইন বলে মনে করা হয় কারণ এতে জামিন পাওয়া ভীষণ কঠিন। তা সত্ত্বেও, ২০২২ সালের অক্টোবরে, বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ সাইবাবাকে অভিযোগ থেকে খালাস দেয় এবং তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এই মুক্তি ছিল নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। মহারাষ্ট্র সরকার হাইকোর্টের আদেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এবং শুক্রবার আক্ষরিক অর্থেই রাতারাতি মামলার রেকর্ডগুলি মারাঠি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করানো হয়।

২০২২-এর ১৫ অক্টোবর, শনিবার বিচারপতি এম আর শাহ এবং বেলা ত্রিবেদীর সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ এক বিশেষ শুনানিতে বম্বে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে। সাইবাবার আইনজীবী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট আর বসন্ত, ভারত সরকারের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেছিলেন, তাঁর মক্কেল শারীরিকভাবে ৯০% অক্ষম একজন ব্যক্তি। তিনি একজন সম্মানীয় অধ্যাপক। আদালত যা বলছে, অর্থাৎ সাইবাবা মাওবাদী কার্যকলাপের 'মূল মাথা' এবং তাঁর সহযোগী অভিযুক্তরা নিছক বোড়ের দল, তা মোটেও সত্য নয়।

সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মন্তব্য করেছিল, "সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ক্ষেত্রে 'মূল মাথা'-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে... এই ধরনের কার্যকলাপের ক্ষেত্রে মূল মাথা খুবই বিপজ্জনক।" সাইবাবার স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে তাঁকে 'গৃহবন্দি' করার অনুরোধও করা হয়েছিল। তবে বিচারপতি শাহ এবং ত্রিবেণীর বেঞ্চ সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা, মহারাষ্ট্র সরকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, "এই অনুরোধগুলি নকশালদের কাছ থেকে খুব ঘন ঘন আসছে, বিশেষ করে শহুরে নকশালদের থেকে। UAPA বিষয়ক অপরাধে, অভিযুক্তদের বন্দি রাখতে হবে। কাউকে ছুরি মারার জন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, কাউকে গুলি করতে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।”

সিনিয়র অ্যাডভোকেট বসন্ত তখন বলেছিলেন, অধ্যাপকের এর আগে অপরাধের কোনও ইতিহাস নেই। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও মামলাও নেই। তিনি আবেদন করেছিলেন, সাইবাবার বাড়ির বাইরে রক্ষীদের মোতায়েন করা হোক। সমস্ত টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হোক, কিন্তু বাড়িতেই থাকতে দেওয়া হোক। এত অসুস্থ শরীরে একজনের চিকিৎসার জন্যই আদালতের কাছে মানবিক অনুরোধ করেছিলেন তিনি। অথচ তুষার মেহতা বলেছিলেন, জেলে একলা কুঠুরিতে বন্দি থাকাই ইউএপিএ অপরাধীদের একমাত্র শর্ত।

বম্বে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায়কে স্থগিত করে সাইবাবা ও অন্যান্য অভিযুক্তদের মুক্তির আদেশ দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ অবশ্য ঘটনা ও পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক মনে করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বম্বে হাইকোর্টের মুক্তির আদেশ স্থগিত করাই উপযুক্ত।

তুষার মেহতার যুক্তি ছিল, সাইবাবার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ গুরুতর, ভয়াবহ এবং তা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করেছে। তথাকথিত শহুরে নকশালরা 'গণতন্ত্রের সংসদীয় রূপকে উৎখাত করতে চায়' বলেই তিনি দাবি করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট ২০২৪ সালের ৫ মার্চ বম্বে হাইকোর্টকে মামলার পুনর্মূল্যায়ন করতে বলে। বিচারপতি বিনয় জি জোশী এবং বিচারপতি বাল্মিকী এস মেনেজেস-এর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সাইবাবাকে (পাশাপাশি অন্য পাঁচজন ব্যক্তিকেও) আবার মুক্তি দেয়। আদালত মামলাটিকেই অবৈধ বলে ঘোষণা করে। বলে, যে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে তা অযৌক্তিক এবং অপর্যাপ্ত। ট্রায়াল কোর্ট যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিল, তা আসলে 'বিচারের ব্যর্থতা'।

সাইবাবা ছাড়াও, যাঁদের UAPA-এর অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁরা হলেন সাংবাদিক প্রশান্ত রাহি, মহেশ টিকরি, হেম কেশবদত্ত মিশ্র এবং বিজয় নান টিকরি। মামলার ষষ্ঠ ব্যক্তি, পাণ্ডু নরোতে, রায়ের অপেক্ষা করতে করতে ২০২২ সালের অগাস্টে মারা যান। মহারাষ্ট্র সরকারের দাবি ছিল, অভিযুক্তরা সবাই নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার (মাওবাদী) সদস্য। উল্লেখ্য, ট্রায়াল কোর্টে সাইবাবার হয়ে লড়ছিলেন যে মানবাধিকার আইনজীবী সুরেন্দ্র গাডলিং, বিচার শেষ হওয়ার পরেই এলগার পরিষদের মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করে নেওয়া হয়।

একই দিনে, হাইকোর্টের রায় দেওয়ার আগে এবং ২৯৩-পৃষ্ঠার রায়ের একটি অনুলিপি প্রকাশের আগেই বম্বে হাইকোর্টের মুক্তির দ্বিতীয় নির্দেশকেও সুপ্রিম কোর্টে একটি বিশেষ ছুটির আবেদন দাখিলের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এর থেকে এটুকু অত্যন্ত স্পষ্ট যে ভারতের বিচার ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে! বিশেষ করে যদি নয়াদিল্লির সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু ব্যক্তি একজন ব্যক্তিকে শেষ করতে উঠে পড়ে লাগেন তাহলে কী ঘটে তা স্পষ্ট! অথচ একবার নয়, দুইবার দেশের শীর্ষ আদালত সাইবাবাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সাইবাবা বলেছিলেন, তিনি যে বেঁচে আছেন এটাই আশ্চর্যের বিষয়। এর ঠিক সাত মাস পর তিনি চলে গেলেন। ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতোই সাইবাবার মামলাটিকেও 'বিচারি বিভাগীয় হত্যা' বলা যেতে পারে। সাইবাবা চিকিৎসার গবেষণার জন্য তার দেহ দান করে গেছিলেন। এই শেষ মুহূর্তে সাইবাবার প্রতি শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছিলেন তাঁর কমরেড জঞ্জেরলা রমেশ বাবু, তেলঙ্গানা ফোরাম এগেইনস্ট ডিসপ্লেসমেন্টের সভাপতি।

প্রিয় চিকিৎসকরা,
আপনারা যখন সাইবাবার চোখ দু'টি তুলে নেবেন,
আলতো করে ছুঁয়ে দেবেন,
যে পৃথিবীর স্বপ্ন সে দেখেছিল তার চিহ্ন রয়ে গেছে ওই দুই চোখে,
অন্য কোথাও অন্য কারও চোখে সেই স্বপ্ন ফুটে উঠবে একদিন।
খুব ধীরে, যত্নে ওর হৃদয় বের করে আনবেন আপনারা,
কারণ ওই দৃঢ় হৃদয়ই মৃত্যুকে অস্বীকার করেছিল!
ফ্যাসিবাদী, মনুবাদী শাসনের কারাগারে,
আদিবাসী ও নির্যাতিত জনগণের জন্য
করুণার নরম শিকড় খুঁজে পেলেও পেতে পারেন আপনারা।
অবিরাম বন্দি থেকে, অসুস্থ দেহে লড়াই করে,
তবু তো বিশ্বাসের জমিতে ফাটল ধরেনি ওর।
পরীক্ষা করে দেখুন, হয়তো সেই পোলিও-আক্রান্ত পা-গুলোই
ছাপ রেখে যেতে পারে ওইসব
গিরগিটিদের মধ্যে যারা প্রতিদিন নয়া আদর্শের প্রচার করে।
এই শেষ, শেষ এক চূড়ান্ত অনুরোধ...
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ওর সেই মাথাটিকে যত্নে রেখে দিন,
নব্বই শতাংশ প্রতিবন্ধী হলেও,
ওর চিন্তক মনই তো শোষণের ভিত ভয়ে কাঁপিয়েছে।
হয়তো কখনও, কোনও দিন, ঘুণধরা নিয়মের দুর্বল সুতোকে চিনিয়ে দেবে
এই অদম্য মনই!

Featured Book: As Author
Media Ethics
Truth, Fairness and Objectivity
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
The Modi Myth