দেশের মঙ্গল আদানির শ্রীবৃদ্ধিতেই? মোদির হাত ধরে যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে আদানি গোষ্ঠী

পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও আয়ুশ জোশী:

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আদানিগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠতার কথা কারওরই অজানা নয়। এ নিয়ে প্রায়শই বিরোধীদের নানা তির্যক মন্তব্যের মুখে পড়তে হয় মোদি সরকারকে। তবে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, গৌতম আদানির ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক ভাবে সম্প্রসারণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে সাহায্য করেই থাকেন মোদি। বিশেষত বন্দর, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ, কয়লা খনি এবং অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে তো বটেই। ২০১৫-র শুরুর দিকে ভারতীয় একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, মোদি যেখানে যেখানে গিয়েছেন, আদানিও পিছু পিছু সেখানে পৌঁছেছেন। তবে এই ব্যাপারটা যে ভারতের পক্ষে সব সময় মঙ্গলজনক হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং বহু সময়েই 'বন্ধু' শিল্পপতির স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে পড়শি দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আঘাত করে বসেছেন মোদি। শুধু পড়শি দেশই নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা সত্য।

গত এক দশকে ভারতের বাইরে আদানি গোষ্ঠীর সম্প্রসারণ কীভাবে যেন মোদির আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, আদানির বহু আন্তর্জাতিক চুক্তিই সাক্ষরিত হয়েছে, সেই সব দেশে মোদির সরকারি সফর বা বা সেই সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের ভারত-সফরের পরে পরেই। ফলে বিষয়টি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই সব হস্তক্ষেপ বহুক্ষেত্রেই ভারতের জন্য খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, ইজরায়েস, কেনিয়া, মায়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং তানজানিয়ায় আদানি গোষ্ঠী যে ভাবে তাদের বাণিজ্যকে সম্প্রসারণ করেছে বা সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদতে ভারতীয় স্বার্থের ক্ষতি হয়েছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে,মার্কিন শর্ট সেলিং সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের একটি রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছিল, কর্পোরেটের ইতিহাসে প্রতারণার সবচেয়ে বড় মিনার তৈরি করেছে আদানি গোষ্ঠী। যদিও আদানি গোষ্ঠীর মুখপাত্র ওই রিপোর্টকে ভারতের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ভারতের জাতীয় পতাকাকে নিজেদের ভিডিওয় ব্যবহার করে আদানি গোষ্ঠীর তরফে প্রমাণ করার সর্বৈব চেষ্টা করা হয় যে দেশের মঙ্গলই মূল উদ্দেশ্য তাদের। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হল, আদানির ব্যবসার প্রচার করতে গিয়ে শেষমেশ কেনিয়া, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো একাধিক দেশের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ককেই ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

কেনিয়ার বিমানবন্দর প্রকল্প

কেনিয়ায় বিরাট বিক্ষোভের মুখে পড়েছিল আদানিরা। কেন? তার নেপথ্যে ছিল দেশটির প্রধান বিমানবন্দর ইজারা নেওয়া ও তার আধুনিকীকরণ প্রকল্পে আদানি গোষ্ঠীর জড়িয়ে পড়া। কেনিয়ার নাগরিকেরা তো বটেই, বেশ কয়েকটি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন নাইরোবিতে জমায়েত করে আদানির ওই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিল। তারা দাবি করে, আদানির ওই প্রকল্প আদতে রাষ্ট্রস্বার্থের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো। ভারত সরকারের বিলাসবহুল ওই অতিথিশালায় সেদিন উপস্থিত ছিলেন দু'দেশেরই নানান কূটনৈতিকবর্গ। কিন্তু সকলের ভিড়ে আরেকজন অপ্রত্যাশিত অতিথি উপস্থিত ছিলেন সেদিন, তিনি গৌতম আদানি। ভারতের তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম ধনকুবের।

তো সেই বৈঠকে নানা ব্যাপার নিয়ে রুটোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল মোদির। তার মধ্যেই উঠে এসেছিল বিমানবন্দর আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে ভারতের দক্ষতার কথা। ওই বৈঠকের তিন মাস যেতে না যেতেই ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কেনিয়ার সরকারের কাছে আদানি গ্রুপের তরফে একটি বিস্তারিত প্রস্তাব জমা পড়ল নাইরোবির জোমো কেনিয়াত্তা ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর (JKIA) আধুনিকীকরণের। যেখানে ৩০ বছরের লিজ এবং যে সংস্থা বিমানবন্দরটি চালায়, তাদের ইকুইটি স্টেকের বিনিময়ে ১.৮৫ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছিল।

চলতি বছরের জুন মাসে, আদানির ওই প্রস্তাব পেশের মাস দুয়েক পরেই কেনিয়ার সরকার ওই বিমানবন্দর আধুনিকীকরণের জন্য দরপত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। আদালতে জমা পড়া একটি আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, সে দেশের সরকার বিমানবন্দর আধুনিকীকরণের বরাত দেওয়ার ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার একটি সংস্থা থেকে আদানির গ্রুপকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। যদিও পরে কেনিয়ার একটি আদালত ওই বিমানবন্দর নিয়ে আদানির এগোনোর উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। কার্যত কেনিয়ার বিমানবন্দরের চুক্তিটিকে হুইসল ব্লোয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন নেলসন আমেনিয়া নামে এক ব্যক্তি, যিনি টুইট করে দাবি করেন, শুধু কেনিয়া নয়, সুইৎজারল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা-সহ একাধিক দেশে দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে। আর এ নিয়ে মুখ খোলার জন্য খুনের হুমকি পর্যন্ত পেয়েছিলেন নেলসন। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সে রয়েছেন। এই ধরনের সত্যের উপর আলো ফেলে যে আখেরে তার শত্রুবৃদ্ধিই হয়েছে, তা মেনেছেন নেলসন নিজেই। যদিও তাঁর সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে আদানি গ্রুপের তরফে দাবি করা হয়েছিল, নেলসন যা বলছেন তার কোনও ভিত্তি নেই। এমনকী এ সম্পর্কে সংস্থার কাছে কোনও তথ্যও নেই।

বিমানবন্দর বিতর্কের আগে অবশ্য কেনিয়াতেই হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইনস তৈরির জন্য প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি বাগিয়ে ফেলেছে আদানি গোষ্ঠী। পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন গড়ার জন্য আদানি গ্রুপ ও আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের আওতায় থাকা 'আফ্রিকাফিফটি' নামে একটি ইনফ্রাস্ট্রাকটার ইনভেসমেন্ট এনটিটিকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে কাজ করার জন্য ছাড় পাইয়ে দিয়েছিল কেনিয়া ইলেকট্রিসিটি ট্রান্সমিশন কোম্পানি (কেট্রাকো)। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ৭৩৬ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে নতুন করে চুক্তিতে সই করে আদানি গ্রুপ। নতুন বরাত অনুযায়ী, নির্মাণের পাশাপাশি তিরিশ বছরের জন্য ওই ট্রান্সমিশন লাইনগুলির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষন করবে আদানিরা। তবে আদানির প্রতি পদক্ষেপেই যেন আইনি সঙ্কট। এই চুক্তির বিরুদ্ধে কেনিয়ার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল সেখানকার ল সোসাইটি। সেই মামলা নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া না পর্যন্ত চুক্তিটিকে বেআইনি ও গোপনীয়তার সঙ্গে তৈরি বলে আখ্যা দিয়ে স্থগিত রেখেছে হাইকোর্ট।

কেনিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রেইলা ওডিনগা অবশ্য আদানি গ্রুপের সঙ্গে সাক্ষরিত বিতর্কিত চুক্তিগুলির পক্ষেই কথা বলেছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট রুটোর মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন তিনি। কানাঘুষো শোনা যায়, একটি বৈঠকে মোদিই নাকি তাঁর সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। তিনি জানান, কেনিয়ার একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নাকি মোদি সেখানকার একটি বন্দর, একটি বিদ্য়ুৎকেন্দ্র, একটি রেললাইন এবং ভারতের দান করা একটি জলাভূমিতে তৈরি বিমানস্ট্রিপ-সহ একাধিক প্রকল্প দেখতে যান। মোদি দেশে ফেরার পরেই আদানি গোষ্ঠী কেনিয়ার ওই সব প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে।

কেনিয়ার একটি সংবাদ প্রকাশনা সংস্থা 'নেশন' জানাচ্ছে, ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC)-র তথ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে অ্যাপেইরো লিমিটেডের মাধ্যমে প্রায় ৮০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে আদানি। প্রাথমিক অনুমানের চেয়ে তার খরচ প্রায় ৪১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়তে না বাড়তেই সেই স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। সাফারিকম নামে একটি সংস্থা কেনিয়া সরকারের এই ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৩৫৮ মার্কিন ডলারের দরপত্র জমা দেয়। যার মধ্যে ডিজিটাল স্বাস্থ্য সমাধান এবং ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইনস্টল করা রয়েছে। সাফারিকম সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ভিত্তিক সংস্থা অ্যাপেইরো লিমিটেড যেটা কিনা আদানিদের সঙ্গে যুক্ত এবং Konvergenz Network Solutions-র সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠন করার পর, প্রকল্পের খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। প্রলল্পের মূল উপাদান যেমন ডেটা সেন্টার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি, এগুলোর দাম কার্যত ৭ গুণ বেড়ে গিয়ছে। নিরাপত্তা ও সহায়তা খাতে সমাধানের খরচ ৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ক্লাউড ডেটা সেন্টার তৈরির খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৮ মিলিয়ন ডলার থেকে ৩৭.৪ মিলিয়ন।

সেনেটর ওকিয়া ওমতাতাহ আদালতে অভিযোগ করেছেন, সংশোধিত দরপত্রে প্রাথমিক চুক্তিগুলো তেমন ভাবে গুরুত্ব পায়নি। বরং স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত লেনদেনের উপর পরিষেবা কর জারি করে করদাতাদের আর্থিক বোঝা বাড়ানো হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে কেনিয়ার গণকাঠামোর উপরে। পাশাপাশি এ সব ব্যাপারে বিদেশি শক্তির আগ্রহ ও তাদের স্বার্থ নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

তানজানিয়ায় চিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আদানি

সেটা ২০১০ সালের প্রথম দিকের কথা। তানজানিয়া সরকার, চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিংস ইন্টারন্যাশনাল এবং ওমানের স্টেট জেনারেল রিজার্ভ ফান্ড মিলে বাগমোয়ো বন্দর প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই চুক্তিটি ছিল চিনের বিখ্যাত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)- এর অংশ। মহাদেশগুলিকে সংযুক্ত করার পাশাপাশি তানজানিয়াকে পূর্ব আফ্রিকার একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করাই ছিল এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির নেতৃত্বাধীন তানজানিয়া সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে। ৯৯ বছরের ইজারার দাবি ও প্রকল্পের মালিকানা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চিনের ভূমিকার বিষয়টি নিয়েও যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। এক পর্যায়ে এসে সমস্ত রকম কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায় এবং চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিংস ইন্টারন্যাশনাল এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় ২০১৯ সালে। এই পরিস্থিতিতে ওই প্রকল্প সংক্রান্ত অসম শর্ত মানতে অস্বীকার করেন মাগুফুলি। যার ফলে আটকে রাখা হয় চুক্তিটি।

২০১৬ সালে তানজানিয়া গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তানজানিয়ার পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যপারে ভারতের আগ্রহের ব্যপারে কথাবার্তাও চালান মোদি সেই সফরে। ২০২১ সালে প্রয়াত হন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাগুফুলি। প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে আসেন সামিয়া সুলুহ হাসান। বন্দর প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আপত্তি ছিল না তাঁর মাগুফুলির মতো। বরং তিনি বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতেই চাইছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভারতে আসেন হাসান। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পাকাপোক্ত করার ব্যাপারে বিস্তর কথাবার্তা হয় দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে এবং বেশ কয়েকটি চুক্তিতে সইও করেন তিনি।

এর ঠিক এক বছর আগেই ২০২২ সালে আদানি পোর্টস এবং স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড (APSEZ) যৌথভাবে তানজানিয়ায় কৌশলগত বিনিয়োগের পথগুলি খুঁজতে এডি পোর্টস (আবুধাবি বন্দর)-এর সঙ্গে একটি মউ সাক্ষর করে। যেখানে বাগামোয়ো-তে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি জাঞ্জিবারের মঙ্গলপানি মাল্টিপারপাস পোর্টের জন্য় ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং দার-এস-সালাম হার্বারের নতুন তেল জেটিতে ৩০০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বাগমোয়ো ছাড়াও তানজানিয়ার দার-এস-সালামে আরও একটি বড় বন্দর রয়েছে। ২০২৪ সালে আদানি ইন্টারন্যাশনাল পোর্টস হোল্ডিং পিটিই লিমিটেড যা কিনা অ্যাপসেজেরই নিয়ন্ত্রনাহীন, তারা তানজানিয়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের থেকে ৩০ বছরের জন্য ডার-এস-সালেম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল চালানোর চুক্তিতে সই করে।

২০২৪ সালের ৩ অক্টোবরে প্রকাশিত ব্লুমবার্গের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, তানজানিয়ার তরফেই জানানো হয়েছে, হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন তৈরির বিষয়ে আদানি সরকারের সঙ্গে প্রায় ৯০০ মার্কিন ডলারের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্পের বিষয়ে কথাবার্তা বলছে তানজানিয়া সরকার।

মায়ানমারে বন্দর প্রকল্পে ব্যর্থতা

২০১৯ সালে APSEZ-র তরফে ঘোষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা মায়ানমারের সর্ববৃহৎ শহর ইয়াঙ্গনের বন্দরে টার্মিনাল তৈরির বরাত জিতে নিয়েছে। সেই প্রকল্পে প্রায় ২৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের কথাও ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশের উপস্থিতি প্রসারিত করার ক্ষেত্রে এটিকে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেই দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালের মধ্যেই ১২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়,তার মধ্যে জমি লিজ দেওয়ার জন্য অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মতো।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে আদানি গোষ্ঠীর প্রধান গৌতম আদানিপুত্র তথা APSEZ-র সিইও করণ আদানি মায়ানমারের বর্তমান ডি ফ্যাক্টো সরকারপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। যিনি কিনা পরবর্তীতে দেশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবেন। তার আগেই ভারতের গুজরাটে এসে মুন্দ্রা বন্দর পরিদর্শন করে গিয়েছেন হ্লাইং, এবং আদানি গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য ও উপহারও বিনিময় করেন। যদিও সেই দাবি অস্বীকার করে আদানি গোষ্ঠী। ততদিনে কিন্তু জেনারেল ও মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৃশংস অত্যাচার ও গণহত্যার (২০১৭) অভিযোগ উঠে গিয়েছে। আমেরিকা সরকার হ্লাইং-নেতৃত্বাধীন সেনা জুন্টার উপরে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। কিন্তু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আদানি মায়ানমার ইকোনমিক কর্পোরেশনকে (এমইসি)-কে ৩০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা কিনা জুন্টার সঙ্গে যুক্ত একটি সংস্থা। যথারীতি সেই রিপোর্টও অস্বীকার করে আদানিগোষ্ঠী জানায়, তারা কোনও অন্যায় করেনি এবং বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার যে নিয়ম তা মেনেই তারা বিনিয়োগ করেছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণঅভ্যুত্থান হল মায়ানমারে। যার ফলাফল হিসেবে উৎখাত করা হল আং সান সু চি-র সরকারকে। সাধারণ নাগরিকদের বিক্ষোভ দমন করতে ব্যাপক দমনপীড়ন চলল মায়ানমার জুড়ে, যার বলি হল প্রায় ১ হাজার মানুষ। এর পরেই আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমের দেশগুলি মায়ানমারের সামরিক শাসনের উপরে আরও একগাদা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলি বন্দরের সঙ্গে জুন্টার যোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। আদানিওয়াচ সে সময়ে মায়ানমারের স্বৈরশাসক তথা জেনারেল হ্লাইংয়ের সঙ্গে আদানির ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পেশ করে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে গণবিক্ষোভের পরে আদানি পোর্টসকে Dow Jones Sustainability Index-এর তালিকা থেকে বের করে দেওয়া হয়। সে মাসেই আদানি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নিষেধাজ্ঞা ও জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে বন্দর প্রকল্প থেকে সরে আসতে পারে আদানি গোষ্ঠী। ২০২১ সালের অগস্ট মাসে আদানির তরফে ঘোষণা করা হয়, মায়ানমার প্রকল্পে আর এগোচ্ছে না তারা। ২০২২ সালের মে মাসে বন্দর প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার জন্য MEC-র সঙ্গে একটি শেয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (SPA)-ও সই করে তারা। প্রাথমিক বিক্রয় মূল্য স্থির হয় ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যদিও চুক্তির শর্ত পূরণে চ্যালেঞ্জ-সহ বেশ কিছু বাধার কারণে সেই বিক্রয়প্রক্রিয়ায় বেশ দেরি হয়। এমনকী তা গড়ায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত। বিক্রির শর্ত নিয়ে আদানিকে পুনরায় আলোচনায় বসতে হয়। দেখা যায়, ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ইয়াঙ্গন বন্দরের সম্পদ মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলারই বিক্রি করতে পেরেছে APSEZ। এই ঘটনা কার্যত সংস্থার সামগ্রিক মুনাফাকে প্রাভাবিত করেছে। বিশেষত ২০২৩ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে আদানি গোষ্ঠীর প্রায় ১২.৭৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

আদানিকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক উত্তেজনা

সদ্য প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। ক্ষমতায় এসেছে বাম সরকার। কুর্সিতে বসেই প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমার দিশানায়েকে আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া ৪৪০ মিলিয়ন ডলারের উইন্ড পাওয়ার প্রকল্পটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়, সাম্প্রতিক মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওই চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তার পরেই তা পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কলম্বো বন্দর তৈরি নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল আদানি গোষ্ঠীর সফর। এই কলম্বো বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শিপিং হাব হিসেবে পরিচিত তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। প্রতিশ্রুতিময় প্রকল্প হিসেবে যার শুরুটা হলেও ক্রমশ ভারতের পক্ষে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই বন্দর। ২০১৯ সালে আদানি পোর্টস এবং স্পেশাল ইকোনমিক জোন (APSEZ)-এর কাছে অন্যতম আকর্ষনীয় প্রকল্প ছিল কলম্বো বন্দরে ইস্ট কনটেইনার টার্মিনাল (ECT)-র তৈরির কাজ। যা ভারতের ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবেও দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালে বেশ কয়েক দফা আলোচনার পর গোতাবায়া রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন সরকার রাজি হয় ওই ECT নির্মাণের কাজে ভারত ও জাপানকে জড়াতে। চুক্তি অনুযায়ী, ৫১ শতাংশের মালিকানা থাকে শ্রীলঙ্কার পোর্টস অথোরিটি (SLPA)-র কাছে। বাকি ৪৯ শতাংশ থাকে ভারত তথা আদানি গোষ্ঠী এবং জাপানের কাছে। এই চুক্তি যখন হচ্ছে, সেসময় ট্রেড ইউনিয়ন, বন্দরকর্মী থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে কড়া বিরোধিতা এসেছিল। দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পত্তি বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল প্রায় সব পক্ষ। তারা জানায়, যদি সত্যিই ECT-কে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হত, তাহলে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার মালিকানা সম্পূর্ণ ভাবে নিজের হাতে রাখত শ্রীলঙ্কা। দেশ জুড়ে যেভাবে বন্দর শ্রমিকেরা বিষয়টি নিয়ে ধর্মঘট ও গণবিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল, তা সরকারের উপরে ক্রমাগত চাপ তৈরি করছিল। ২০২১ সালে এই সমস্ত ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে AdaniWatch.org। এই ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও রাজনৈতিক চাপের মুখে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ECT প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। কার্যত এই উত্তেজনা কিন্তু ছড়িয়েছিল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কেও। এই প্রকল্প বাতিল হওয়ায় ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে ভারতের যে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তা-ও বেশ বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে আদানি গোষ্ঠীকে ECT-র বদলে কলম্বো বন্দরে ওয়েস্ট কনটেইনার টার্মিনাল (WCT) গড়ার প্রস্তাব দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার। তবে এই WCT গড়ার চুক্তি ছিল ECT প্রকল্পের থেকে আলাদা। ৩৫ বছরের নির্মাণ, পরিচালনা ও স্থানান্তরে (BOT)-এর চুক্তি হয় আদানির সঙ্গে, যেখানে ৮৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে আদানির হাতে, বাকি ১৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে। WCT গুরুত্বপূর্ণ হলেও ECT-র মতো কৌশলগত অবস্থান তার ছিল না। তা সত্ত্বেও আদানি সেই বিকল্প চুক্তিতে রাজি হয়। ততদিনে উইন্ড পাওয়ার প্রজেক্টের মাধ্যমে দ্বীপরাষ্ট্রে নিজেকে সম্প্রসারিত করতে শুরু করেছে আদানিরা। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় যখন চরম আর্থিক সঙ্কট দেখা যায়, তখন ভারতের তরফে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়। সেই সময়েই এই চুক্তিটি পেয়েছিল আদানি। ২০২১ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার সিলন ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের (CEB) চেয়ারম্যান সংসদীয় কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি নাকি ওই প্রকল্পের বরাত আদানিকে দেওয়ার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের উপরে যথেষ্ট চাপ তৈরি করেছিলেন। তার কয়েক দিন পরেই CEB চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে মোদি-গোতাবায়া সাক্ষাতের ঠিক পরেই উঠে এসেছিল সেই সাক্ষ্য। যদিও তিনি পরে নিজের বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন, তবে ততদিনে তা ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এই প্রথম অবশ্য নয়। ২০২২ সালের মার্চে মান্নার ও পুনরিনে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প বিকাশের জন্য CEB ও আদানি গ্রিন এনার্জির মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দল সামাগি জনা বালাওয়েগয়া (SJB) দাবি করেছিল, আদানি এই প্রকল্পে ব্যাকডোর দিয়ে প্রবেশ করেছে। অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় আদানিকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে গোতাবায়া সরকারের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনা করা হয় SJB-র তরফে, আদানিকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই তা করা হয় বলেও অভিযোগ।

২০২৪ সালে সেই বিতর্কে আরও ঘি পড়ে যখন শ্রীলঙ্কার পাবলিক ইউটিলিটি কমিশন ৪৮৪ মেগাওয়াট একটি উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের ব্যাপারে আদানিকে প্রত্যাখ্যান করে। অগস্ট মাসে সেই প্রকল্পটি আইনি জটিলতায় থমকে যায়। কারণ বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট ও সেন্ট্রাল এনভায়রনমেন্ট অথরিটি বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার উপর ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই স্বর চড়িয়ে আসছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে। সম্প্রতি একটি টক শো-তে এসে আদানি উইন্ড পাওয়ার প্রজেক্টটি বাতিল করার কথা ঘোষণা করেন তিনি। জানান, তাঁদের শক্তির সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে এই প্রকল্প, সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত। তার পরেই আদানিকে পূর্ববর্তী সরকারের দেওয়া বায়ুপ্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনার কথাও জানান দিশানায়েকে।

বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎচুক্তি নিয়ে জটিলতা

২০১৫ সালের জুন মাসে মোদি বাংলাদেশ সফরে যান। সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায় বলেও ঘোষণা করেন মোদি। তার মাস দু'য়েক বাদেই আদানি বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড (BPDB)-র সঙ্গে একটি মউ সাক্ষর করে আদানি গোষ্ঠী। ঠিক হয়, ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা এলাকার একটি ১৬০০ ওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির কাজে লাগানো হবে। সেই উদ্দেশ্যে গোড্ডায় তৈরি হয় সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রও। ভারতের সবচেয়ে বেশি কয়লার মজুত যে ঝাড়খণ্ডেই, সে কথা সকলেরই জানা। ফলে গোড্ডার মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প পৃথিবীতে আর দু'টো নেই বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। যদিও আশ্চর্যের কথা, এই গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রাজ্যেই যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় না। বরং সেই কয়লা জাহাজে চেপে চলে যায় পড়শি রাজ্য ওড়িশার ধামারা বন্দর হয়ে ৯০০০ কিলোমিটার দূরে নর্দান অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোট পয়েন্ট পোর্টে। কুইন্সল্যান্ডের কয়লাখনি এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দর, এই দুটিই নিয়ন্ত্রিত হয় আদানি গোষ্ঠীর হাতে। ধামারায় পৌঁছনোর পর ওই কয়লা ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোড্ডায় ইজারা দেওয়া রেললাইন বরাবর সরিয়ে ফেলা হয়। যে রেললাইন প্রসারের বিরোধিতা করেছিলেন আদিবাসীরা, এবং তার জন্য তারা বাস্তুচ্যুতও হয়েছিল। গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা বাংলাদেশের ভেড়ামারায় ১০০ কিলোমিটার এলাকায় ট্রান্সমিটেড হয়, সেখান থেকে ফের পুনর্বণ্টন করা হয়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নয়াদিল্লি আসেন, তখন দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে এই প্রকল্প নিয়ে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ অভিযোগ তোলে, বাংলাদেশের তুলনায় এই চুক্তিতে আদানির লাভের ব্যাপারটিই বেশি মাথায় রাখা হয়েছে। যদিও তার পরেও প্রকল্প থমকায়নি। তার মধ্যেই বিদ্যুতের দাম নিয়ে উদ্বেগ দেখা যায়। এই প্রকল্পকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বলে হইচই শুরু হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশকে দেশের গড় বিদ্যুৎ খরচার প্রায় পাঁচ গুণ দাম দিতে হত আদানির থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য। যদি ওই প্রকল্পে একফোঁটা বিদ্যুৎও উৎপাদিত না হয়, সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে অ্যানুয়াল ক্যাপাসিটি এবং মেইনটেনেন্স বাবদ প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে যেতে হবে প্রায় ২৫ বছর ধরে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও আদানির মধ্যে হওয়া এই চুক্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল আদানিওয়াচের একটি প্রতিবেদনে। আদানি যে যে খরচগুলিকে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, সেগুলোকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় সেখানে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে সই হওয়া পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (PPA) -এ ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) এবং অন্যান্য কর আলাদা ভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ভারতে পণ্য পরিষেবা কর তথা জিএসটি ব্যবস্থা কার্যকর করা হল। কেন্দ্রীয় আবগারি শুল্ক, পরিষেবা কর, অতিরিক্ত শুল্ক, সারচার্জ, রাজ্য-স্তরের ভ্যাট, অক্টোয় (একটি পরিবহন-সম্পর্কিত কর) এবং আন্তঃরাজ্য পণ্য চলাচলের জন্য শুল্ক-সহ বেশিরভাগ পরোক্ষ করই ঢুকে গেল এই জিএসটির আওতায়। প্রশ্ন ওঠে, তবে কেন এই মেয়াদোত্তীর্ণ করগুলি PPA-র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রইল? ওঠে প্রশ্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি সাক্ষর হওয়ার ১৫ মাস পরে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গোড্ডা প্রকল্পটিকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone বা SEZ) হিসেবে মনোনীত করা হয়। হিসেব মতো ভারতের SEZ-গুলি বেশ কিছু করছাড় পায়। পাশাপাশি APJL গোড্ডা এমনিতেই প্রায় সমস্ত আমদানিকৃত জিনিসের উপর আরোপিত কর এবং দীর্ঘমেয়াদি আয়করের হাত থেকে রেহাই পেয়ে থাকে। শোনা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তিটি রাজনৈতিক চাপে স্ট্যান্ডার্ড রিভিশন ছাড়াই সই হয়ে গিয়েছিল। আর তা হয়েছিল আদানি-মোদির বন্ধুত্বের কারণেই। পুননর্বীকরণযোগ্য শক্তির জন্য বৈশ্বিক চাপ ও পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ কয়লা ভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করলেও গোড্ডা প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা।

চলতি বছরের জুলাই-অগস্ট মাসে ঢাকায় শুরু হয় ভয়াবহ বিক্ষোভ। ২০২৪ সালের ৫ অগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দু'দিন পরে নোবেলজয়ী মুহম্মদ ইউনূসের হাতে যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভার। পরবর্তীকালে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের সেই চুক্তিটি পুনবির্বেচনার জন্য খাতায়-কলমে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নামে বার্লিনের একটি সিভিক সোসাইটি অর্গানাইজেশন বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির এই চুক্তিকে বৈষম্যমূলক, অস্বচ্ছ বলে চিহ্নিত করেছে। কার্যত এই চুক্তি বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী, হাসিনা-বিরোধী মনোভাবকে আরও কড়া করেছে বলেই তাদের মত। হাসিনা ভারতের আসার এক সপ্তাহ পরে ১২ অগস্ট ভারত সরকার বিতর্কিত এই গোড্ডা কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা মাথায় রেখে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ রপ্তানির নির্দেশিকাটি সংশোধন করে। মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশে সরকার পরবর্তনের পরে আদানির ক্ষতি আটকাতেই এই সিদ্ধান্ত মোদি সরকারের। এর এক সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ২৭ অগস্ট নাগাদ আদানি গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিক ভাবে ইউনূস সরকারের কাছে গোড্ডা থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সরবরাহ ররা বিদ্যুতের জন্য ৮০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার দাবি করে। এদিকে নয়া সরকার দেশের অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য পূর্বতন সরকারের ব্যয়বহুল অবকাঠামো চুক্তিকেই কাঠগোড়ায় তুলেছেন। ইউনূস মন্ত্রিসভার এনার্জি অ্যাডভাইজার মুহম্মদ ফৌজুল কবীর খান মেনে নিয়েছেন, তারা ভয়ঙ্কর আর্থিক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পাওয়ার সেক্টরে মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশে। যার মধ্যে ৪৯২ ডলার একা আদানির কাছেই দেয়। আর এ নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক জারি রয়েছে।

ইজরায়েলে আদানি

ইজরায়েলেও একই রকম বিতর্ক ছড়াতে সফল হয়েছেন আদানি। ইজরায়েলের বৃহত্তম হাইফা বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গিয়েছিল আদানির হাতে। কার্যত এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করার জন্য পশ্চিম এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য জোরদার করার ক্ষেত্রে বৃহত্তর কৌশলগত কূটনীতির অংশ হিসেবেই আদানির এই পদক্ষেপকে দেখিয়েছিল নয়াদিল্লি। কিন্তু এই চুক্তিটিও একই ভাবে সমালোচিত হয়। কারণ এর ফলে এলাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারত সরকারের সমালোচকদের যুক্তি, মোদি নেতৃত্বাধীন ভারতে আদানির সঙ্গে এই চুক্তিটি আদতে প্যালেস্টাইনের থেকে তার ঐতিহ্যগত সমর্থনের জায়গা থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল ও অন্যান্য রক্ষণশীল শাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা লাভ করেছে। মোদিই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি তেল আভিভ সফর করেন। ২০১৭ সালে ইজরায়েলে যান মোদি। তবে ইজরায়েলে আদানির এই ঘনিষ্ঠতার নেপথ্যে রয়েছে সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের বিনিময়ও। যেমন টেভর অ্যাসল্ট রাইফেল, হারমেস ড্রোনের মতো অস্ত্রশস্ত্র, যা সাম্প্রতিক যুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সমালোচকেরা মনে করছেন, ইজরায়েলের যে বিতর্কিত এথনো ন্যাশনালিস্ট পলিসি, তাকে আসলে কৌশলে সমর্থন করছে ভারত।

এই দুই দেশের সম্পর্ক আব্রাহাম কাঠামোর আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, সৌদি আরব এবং মিশরের মতো পশ্চিম এশিয়ার মতো দেশগুলিতে কৌশলগত সহায়তার চেষ্টা করে। যার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে একটি অর্থনৈতিক অ্যাঙ্গেলও। কী সেটা? অপরিশোধিত তেল আমদানি। আপাতত ভাবতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল দেশের বিদেশনীতি আদানির মতো একজন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে ঠিকঠাক সামঞ্জস্য রেখে এগোতে পারছে কিনা। স্বাভাবিক ভাবেই সেটা কতটা ন্যায্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই যায়।

২০১৮ সালে আদানি এন্টারপ্রাইজ ও ইজরায়েলের বৃহত্তম অস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থা এলবিট সিস্টেমস একটি যৌথ উদ্যোগে সামিল হয়। আদানি এলবিট অ্যাডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে এই উদ্যোগে জোর দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধে ব্যবহৃত ড্রোন হার্মিস ৯০০ ইউএভি তৈরির উপরে। যা প্রায়শই ইজরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) ব্যবহার করে থাকে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধে একাধিক সেই অস্ত্রের ব্যবহার করেছে নেতানিয়াহু সেনা। দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই উপকূল থেকে রওনা হয়ে ২০২৪ সালের মে মাসে ইজরায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল একটি জাহাজ, যাকে আটকানো হয় স্প্য়ানিশ উপকূলে। জানা যায়, গাজার নুসরাইতে রাষ্ট্রপুঞ্জের যে শরণার্থী শিবিরের যে হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল, তাতে ব্যবহৃত মিসাইল নাকি ভারতে তৈরি। যার গায়ে সংস্থার নাম হিসেবে লেখা ছিল প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভ লিমিটেডের নাম। যদিও আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে এই সংস্থার কোনও সম্পর্ক নেই।

আদানি ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়ারে পিএলআর স্থাপন করতে ইজরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রি (IWI)-র সঙ্গে অংশীদারিত্ব করছে। আর এই যৌথ উদ্যোগে ৫১ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে আদানির। এই উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে তাভর এবং X95 অ্যাসল্ট রাইফেব, নেগেভ লাইট মেশিনগান, গ্যালিল স্নাইপার রাইফেলের মতো বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। ২০০৫ সালে বেসরকারিকরণ হয় এই ইজরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রি (IWI)-এর। আদানির সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই নিজেকে সম্প্রসারিত করেছে সংস্থাটি।

প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বড় হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিনে দিনে আরও বেড়েছে আদানি গোষ্ঠীর। ২০২২ সালে IWI-র সহযোগিতায় গুজরাটে ডেফএক্সপো-তে ARBEL নামে একটি AI-পরিচালিত স্মল-আর্মস সিস্টেম নির্মাতা সংস্থা তৈরি করে আদানি গোষ্ঠী। আদানি এবং মোদি, দু'জনেই চান গুজরাটকে অস্ত্রের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে।

এখানেই শেষ নয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আদানি গোষ্ঠী টাওয়ার সেমিকন্ডাক্টর নামে ইজরায়েলি একটি সংস্থার সঙ্গে জোট বাঁধে মহারাষ্ট্রে একটি চিপ উৎপাদনকারী কারখানা তৈরির উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যেই সেই প্রকল্পে প্রায় ৮৩.৯৪৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে। যা প্রতি মাসে অন্তত ৪০ হাজার ওয়েফার (সেমিকন্ডাক্টরের একটি পাতলা টুকরো উপাদান যা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) তৈরি করবে। পরবর্তীতে তার উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই চিপগুলি ড্রোন, গাড়ি এবং স্মার্টফোনে ব্যবহৃত হয়।

গ্রিসে আদানি, তৈরি হচ্ছে আরও একটি বন্দর

২০২৩ সালে গ্রিস সফরে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনিই প্রথম ভারতীয় নেতা যিনি চল্লিশ বছরে প্রথম কূটনৈতিক সফরে গ্রিসে গেলেন। তবে গ্রিক মিডিয়া সূত্রের খবর, প্রথা মাফিক সরকারি বৈঠকের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু এই সফরের নেপথ্যে। এবং তা অনুমান করা কঠিন নয়। গ্রিক বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপে আদানির বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করার পথ প্রশস্ত করাও এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। শোনা গিয়েছে, গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিসের সঙ্গে মোদির আলোচনায় উঠে এসেছে কাভালা, ভোলোস এবং আলেকজান্দ্রোপলির মতো বন্দরগুলিতে আদানি অংশীদারিত্ব অর্জনের সম্ভাবনার কথা। ইউরোপের গভীরে ভারতের রফতানির পথকে প্রশস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে হিসেবে দেখা হচ্ছে এই বন্দরগুলিকে। গ্রিসের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য-মূল্যের পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। সূত্রের খবর, দু'দেশের নেতাই এটিকে একটি ট্রানজিট হাবে রূপান্তর করতে চাইছেন, যা ভারতীয় ব্যবসাগুলিকে ইউরোপীয় বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবে।

পাইরাস বন্দর, যা ভূমধ্যসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আউটপোস্ট হিসেবে গণ্য হয়, সেই বন্দরের কথাও উঠে এসেছে মোদির সঙ্গে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায়। এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগটাই চিনের কসকো শিপিংয়ের হাতে। ফলে সেখানে ভারতের এই হস্তক্ষেপের চেষ্টা আদৌ সফল হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে আদানির পক্ষে ভারতের এই ধরনের আলাপআলোচনায় যোগদান লাভজনক হতে পারে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালেই অভিবাসন ও মবিলিটি-র সংক্রান্ত একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে ভারত সফরে আসেন গ্রিক প্রধানমন্ত্রী।

ইন্দোনেশিয়ায় কৌশলগত বন্দর এবং কয়লা কেলেঙ্কারি

ইন্দোনেশিয়ায় আদানি গোষ্ঠীর আধিপত্য আগে থেকেই কায়েম রয়েছে। কয়লা খনি ও ইনফাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট সংক্রান্ত আদানি গোষ্ঠীর একাধিক ব্যবসা ইতিমধ্যেই রয়েছে সেখানে। পিটি আদানি গ্লোবালের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় পা রাখে তারা, যেটি কয়লাখনির লজিস্টিক সরবরাহ করে থাকে মূলত। ২০০৭ সালে ‘exploitation licence’ নিয়ে কাজ শুরু করে সংস্থাটি। নর্থ কালিমান্তান ( বর্নিও) প্রদেশের বুনিউ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে রয়েছে সেই কয়লা খনি ও বন্দরটি। বুনিউ দ্বীপে, বিশেষত স্থানীয় তিদুং সম্প্রদায়ের উপরে আদানি গোষ্ঠীর এই কয়লাখনিটির নেতিবাচক প্রভাবের কথা আগেই উল্লেখ করেছিল আদানিওয়াচ। জাতাম নামে ইন্দোনেশিয়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখি হয়েছে।

অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (OCCRP)-র প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে, ২০১৪ সালের ৯ জানুয়ারি এমভি কালিওপি এল নামে একটি মালবাহী জাহাজ ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রায় দু'সপ্তাহ যাত্রা করার পর এসে ভেড়ে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের এন্নোর বন্দরে। কী ছিল সেই জাহাজে? জাহাজে ছিল ৬৯,৯২৫ টন কয়লা। যা সরকারের রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী সংস্থা TANGEDCO-র জন্য পাঠানো হয়েছিল। তবে জাহাজের কাগজপত্র বলছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর ঘুরে তবে ভারতে পৌঁছেছে কয়লাভর্তি জাহাজটি। তবে কাগুজে এই পথ আদতে কাল্পনিক। পরিকল্পনা করেই 'ট্যাক্স হেভেন' হিসেবে খ্যাত এই দুই জায়গা থেকে ঘুরিয়ে আনার কথা কাগজকলমে লেখা হয়েছে, এবং এর মাধ্যমে কয়লার দামও প্রতি মেট্রিক টনে ৯১.৯১ ডলার করে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই কাল্পনিক পথে আসতে আসতে কয়লার মানও খারাপ থেকে ভালোয় পরিবর্তিত হয়েছে, ঠিক যেমনটা প্রয়োজন বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থায় ব্যবহারের জন্য।

না, এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। OCCRP এ ব্যাপারে একাধিক প্রমাণ 'ফিনান্সিয়াল টাইমসে'র সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে, যেখানে অভিযোগ উঠেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে অন্তত এমন ২৪টি ভুয়ো জাহাজপথের চালান তামিলনাড়ুর উপকূলে এসে পৌঁছয়। যেখানে দেখা গেছে, নিম্ন মানের কয়লার দাম প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে বিক্রি করা হয়েছে। যদিও আদানি গোষ্ঠী এই সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছে। তবে এই সব অভিযোগ প্রমাণের একাধিক সূত্র হাতে এসেছে OCCRP-র। রয়েছে বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কিং রেকর্ড, রাজস্ব গোয়েন্দা অধিদফতর (DRI), ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের শুল্ক দফতরের গোয়েন্দা শাখার তদন্ত রিপোর্ট, আদানির ইন্দোনেশিয়ার কয়লা সরবরাহকারীদের থেকে ফাঁস হওয়া নথি এবং TANGEDCO-র আভ্যন্তরীণ রেকর্ড। ডিআরআইয়ের ২০১২ সালের তদন্তে চল্লিশটি সংস্থাকে চিহ্নিত করে, যারা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত কয়লার দাম এই ভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছিল। যার মাশুল দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তাঁদের বিদ্যুতের বিল চড়চড়িয়ে বেড়েছে। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ মাসে DRI ভারতের প্রায় ৫০টি কাস্টমস অফিসে লুক আউট সার্কুলার জারি করে। যে ভয়ঙ্কর প্রতারণার কারবার চালানো হয়েছে, তা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়।

২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান-ভারত এবং ইস্ট এশিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়ায় যান মোদি। এর ঠিক এক মাস পরে অক্টোবরে মালাক্কা প্রণালির কাছে সাবাং বন্দরে নতুন কন্টেনার টার্মিনাল ও বেশ কিছু ট্রানজিট পোর্ট গড়ার সুযোগ পায় আদানি গোষ্ঠী। যেখানে প্রাথমিক বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। শোনা যায়, এই গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথটি নাকি আগে থেকেই ইন্দোনেশিয়া সরকারের সঙ্গে আলাপচারিতা চালাচ্ছিল আদানি গোষ্ঠী। তবে মোদির সফরের পরেই সেই চুক্তিতে সিলমোহর পড়ে।

নেপালে বিমান রুট ও আদানির উপরে নিষেধাজ্ঞা

নিরাপত্তার খাতিরে বর্তমানে নেপালকে একাধিক হাই অল্টিচিউড পথ ব্যবহারে বাধা দিচ্ছে ভারত। চিনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে থাকে হিমালয় সংলগ্ন দেশটি। ফলে সীমান্তের কাছে ভারতীয় আকাশসীমায় নতুন আকাশপথগুলি অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত সতর্ক নয়াদিল্লি। আর এই ব্যপারটিকে নিয়েই দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উদ্বেগ বেড়েছে। পোখরা, ভৈরহাওয়ার মতো নেপালের একাধিক বন্দর, যেগুলো মূলত চিন থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি, সেগুলি ভারতের বিধিনিষেধের কারণে আর্থিক ভাবে সফল হতে পারছে না।

নেপালের স্থানীয় সংবাদপত্র 'হিমাল খবর' অভিযোগ করেছে, মোদি সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিভিন্ন অজুহাতে পোখরা ও ভৈরবহাওয়া বিমানবন্দরে বিমান ঢুকতে দিচ্ছে না। তাদের দাবি, যতক্ষণ না আদানির সংস্থাকে এই বিমানবন্দর পরিচালনার চুক্তি দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ অসহযোগিতা বাড়িয়ে চলেছে নয়াদিল্লি। সেই সঙ্গে লুম্বিনিতে একটি বিমানবন্দর গড়ার বরাতও আদানিকেই দিতে চায় মোদি সরকার। ভারত ও নেপাল সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা এই বিষয়ে আলাপআলোচনায় বসে ২০২৩ সালের জুন মাসে। সূত্রের খবর, আদানি গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কাঠমান্ডু যান নেপালের সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানে গিয়ে ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছে একটি নতুন বন্দর গড়ার কথাও ঘোষণা করে আসেন আদানিরা। পাশাপাশি ভৈরবহাওয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তার্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণের ভার নেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়। তবে এখনও পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তার আগেই প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে নেপালে। গত ১৫ জুলাই নেপালের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন কেপি শর্মা আলি।

সাম্প্রতিক একাধিক প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, ভুটান ও ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি করার উদ্দেশে নেপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে আদানি গ্রুপ। ২০৫০ সালের মধ্য়ে নেট জিরো কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে নেপালে ১০ গিগাওয়াটস জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পাশাপাশি ভুটান, তানজানিয়া, কেনিয়া ও ফিলিপ্পিনসেও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গোষ্ঠীর।

অস্ট্রেলিয়ায় কারমাইকেল কয়লাখনন প্রকল্প

২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে জি-২০ সম্মেলনের সময় ক্যানবেরা-সহ অন্যান্য শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে মোদি গৌতম আদানি এবং ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক এসবিআইয়ের তৎকালীন প্রধান অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে আদানি গোষ্ঠী ও SBI-র মধ্যে মউ সাক্ষরিত হয়। যেখানে আদানির কারমাইকেল কয়লাখনন প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। অরুন্ধতী রায় সেই কয়লা খনি প্রকল্পের প্রশংসা করলেও সেই ঋণের চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কার্যত আদানির এই কারমাইকেল কয়লা খনি প্রকল্পটি নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। আদিবাসীদের অধিকার খর্ব-সহ একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল এই প্রকল্প। ২০১০ সালে কুইন্সল্যান্ডের গ্যালিলি বেসিনে ওপেন পিট কয়লা খনি তৈরি করার বরাত পায়। প্রাথমিক ভাবে ভারতে কয়লা রফাতানির জন্যই অ্যাবট পয়েন্ট টার্মিনালে কয়লা পরিবহনের একটি রেলপথ নির্মাণের অধিকার পেয়েছিল আদানিরা।

কিন্তু পরিবেশবিদেরা এতে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তনে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আশঙ্কার কথা জানায়। স্টপ আদানির মতো একাধিক সংস্থা এই খনির বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকে। তাদের যুক্তি ছিল, আদানির ব্যপক ভাবে কয়লা উত্তোলন অস্ট্রেলিয়ায় কার্বন ফুটপ্রিন্টকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে দেবে, যার প্রভাব পড়বে ক্লাইমেটের উপরে। জলের ব্যবহার সংক্রান্ত উদ্বেগও ছিল আরও একটি দিক। পরিবেশবিদ ও স্থানীয় কৃষকেরাও যুক্তি দেন, খরাপ্রবণ এলাকা থেকে প্রয়োজনীয় ভূগর্ভস্থ জলসম্পদ টেনে নেবে ওই খনি। স্থানীয় ওয়াংগান এবং জাগালিঙ্গু সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখেও পড়ে ওই প্রকল্প। তারা আইনি লড়াইয়ের পথেও হাঁটে। মামলাও চলে বছরের পর বছর ধরে। যদিও অস্ট্রেলীয় সরকার আদানি গোষ্ঠীকে এই প্রকল্পের ব্যাপারে স্বল্প পরিসরে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিল। তবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির পিছনে যেভাবে বিশ্ব ঝুঁকতে শুরু করে তাতে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল ওই খনির প্রয়োজনীয়তা।

বব ব্রাউন ফাউন্ডেশন-সহ একাধিক পক্ষের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও আদানি সেই খনিতে কয়লা খনন শুরু করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম কনসাইনমেন্টটি রফতানি করে। তবে এত বিরোধিতার ফলস্বরূপ প্রস্তাবিত ধারণক্ষমতার মাত্র এক ষষ্ঠাংশ জায়গা জুড়ে খনির কাজ শুরু করতে পেরেছিল আদানি গোষ্ঠী। আদানির অস্ট্রেলীয় সহযোগী সংস্থাটির নাম রাতারাতি পাল্টে ব্রাভাস মাইনিং অ্যান্ড রিসোর্সেস রাখা হয়। অনেকেই মনে করে, আদানির নামের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা কম বিক্ষোভের মুখে পড়তে পারে। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে গোড়া থেকেই আদানি ভালো রকম ধাক্কা খেয়েছিল। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ঋণ দিতে ব্যর্থ হয়, এমনকী বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ঋণদাতাও মুখ ফিরিয়েছিল আদানির থেকে। যদিও ওই কয়লাবন্দর প্রকল্পের ধার শোধ করার জন্য ২০২৪ সালের জুন মাসে মার্কিন সংস্থা ফ্যারালন ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং কিং স্ট্রিট ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের থেকে ৩৩৩ মিলিয়ন ডলারের বেসরকারি ঋণ জোগার করেছে আদানি গোষ্ঠী।

Featured Book: As Author
Loose Pages
Court Cases That Could Have Shaken India
  • Authorship: Co-authored with Sourya Majumder
  • Publisher: Paranjoy
  • 376 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Calcutta Diary