প্রশ্ন: সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দল দু’টি চরিত্রগত ভাবে এক নয়। এ বিষয়ে আপনার কী মত?
প্রণব বর্ধন: এই কাগজেই নির্বাচনের আগে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম যে, বামপন্থীরা একটা ভুল করছেন— ওঁরা দু’দলকে একই ধরনের শত্রু বলে মনে করছেন। মতাদর্শে ও কর্মপ্রণালীতে বিজেপি এখন ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগৎকে এক ভয়ানক বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক বিষজর্জর স্বৈরতান্ত্রিক হিন্দুরাষ্ট্রই ওদের নিশানা, সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তৃণমূলের অনেক দোষ আছে— গুন্ডামি, সিন্ডিকেটরাজ, তোলাবাজি, দুর্নীতি। তবে বাম জমানাতেও এ সব ছিল, হয়তো তৃণমূল আমলে এ সবের মাত্রাধিক্য হয়েছে। তবে বিজেপি সম্পর্কে দেরিতে হলেও বামপন্থীরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারছেন, সেটা ভাল।
প্র: ৩৪ বছর রাজত্ব করার পর আজ বামেদের এক জনও বিধায়ক নেই। ভুলের মাসুল কি এটা?
উ: ভুল তো নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই ভুলই একমাত্র ভুল নয়। আরও অনেকগুলো জায়গা চিহ্নিত করার রয়েছে। নতুন পথ, নতুন চিন্তা করার দরকার আছে। প্রথমত বামপন্থীদের মনে রাখতে হবে, এই যে স্থানীয় স্তরে দৌরাত্ম্য বা মাফিয়াবাজি, এটাকে নির্মূল না করতে পারলে লোকের মনে তাঁদের সম্পর্কে খুব একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি আসবে না। বিধানসভায় কোনও আসন নেই, কিন্তু কিছু কিছু পঞ্চায়েত-পুরসভা তো এখনও বামপন্থীদের হাতে আছে। সেইখানে হাতেনাতে করে দেখাতে হবে, সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে।
প্র: আমি অন্য একটা বিষয়ে আসি। সিপিএম কি বাংলার সাধারণ মহিলাদের মন থেকে মুছে গেল?
উ: ২০১১ সালে, যখন বাম-রাজত্ব শেষ হল, তখন কেন তারা হেরে গেল, তাই নিয়ে আমরা একটা বড় মাপের গ্রামসমীক্ষা করেছিলাম। এ সব নিয়ে আমার দারিদ্র্য নিয়ে কনফারেন্স (আনন্দ, ২০২০) শীর্ষক প্রবন্ধসংগ্রহে অনেক আলোচনা করেছি। হারার কারণের তালিকায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ব্যাপারের চেয়েও সমীক্ষায় গ্রামের মানুষেরা দুটো কারণকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন: এক, স্থানীয়স্তরের দৌরাত্ম্য; আর দুই, মহিলাদের প্রতি বামনেতাদের আচরণ। নির্বাচনের আগে অনেক বামনেতা মমতাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে মহিলা ভোটাররা বিষয়টা ভাল ভাবে নেননি। ক্ষমতায় আসার পর মমতা বেশ কিছু প্রকল্প শুরু করেছেন— কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার, সম্প্রতি লক্ষ্মীর ভান্ডার ইত্যাদি— যেগুলি মহিলাদের কাছে জনপ্রিয়।
এই অবস্থায় বামপন্থীদের করণীয় কী? মহিলাদের ব্যাপারে বামপন্থীদের খুব সচেতন হতে হবে। দু’একটা করণীয় নীতির উদাহরণ দিই। এক, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায়। পনেরো-ষোলোতেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পগুলো এই প্রবণতা কিছুটা ঠেকিয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বোঝা যায় যে, মহিলারা তাঁদের মেয়েদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভীষণ চিন্তিত। মেয়ের বয়স তেরো-চোদ্দো হলেই ছেলেছোকরারা ঘুরঘুর করতে থাকে। মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলে তাদের নিরাপত্তার ভারটা শ্বশুরবাড়ির উপর বর্তায়। পরিবারের ‘ইজ্জত’ রক্ষার দায়িত্ব মা-বাবাকে বইতে হয় না। নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেকগুলো কাজ বামপন্থীরা করতে পারেন। পঞ্চায়েত থেকে প্রত্যেকটা পাড়ায় একটা মহিলাদের কমিটি করুন। তাদের তদারকিতে কিছু স্বেচ্ছাসেবী কর্মী কমবয়সি মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। দ্বিতীয় উদাহরণ: শিশুশিক্ষা ও পুষ্টির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বড় বেশি অবহেলা; অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পগুলি বড় দুর্বল; আশা-স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন অত্যন্ত কম ও চাকরির অনিশ্চয়তা বেশি— বামপন্থীরা এগুলোকে তাঁদের আন্দোলনের একটি কেন্দ্রবিন্দু করলে মহিলাদের সমর্থন ফিরে পাবেন, দেশেরও মঙ্গল হয়।
প্র: ভোটপর্বে কাজের সুবাদে আমার মনে হয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতাই বামেদের বিপক্ষে গিয়েছে। গ্রামেগঞ্জে যে নিচুতলার সমর্থনের ভিত্তি ছিল, বামেরা তা হারিয়ে ফেলেছেন। আপনি কি একমত? এখন কি কোনও ভাবে বাম দলগুলি এই সমস্যা থেকে বেরোতে পারে?
উ: এখন ওদের যা অবস্থা, তাতে কার সঙ্গে জোট করলে জেতা যায় ইত্যাদি নির্বাচনের কৌশলের চেয়েও সাংগঠনিক পুনর্গঠনের স্তরে ভাবা অনেক বেশি দরকার। আমার মনে হয়, সাংগঠনিক স্তরে দুটো জিনিস খুব তাড়াতাড়ি করা দরকার। আমাদের পুরুষ-প্রধান, উচ্চবর্ণ-প্রধান বয়স্ক বাম-নেতৃত্ব বড় বেশি ভুল-প্রবণ এবং ভুলের পর সেটা বুঝতে বড় দেরি করেন। নেতৃত্বের মাঝারি ও উঁচুস্তরে অনেক মহিলানেত্রী ও যুবনেতা দরকার।
প্র: কিন্তু এ বার তো অনেককে সামনে আনা হয়েছিল। চার-পাঁচ জন যুবনেতা ভোটে লড়েছেন।
উ: আমি শুধু ভোটে দাঁড়ানোর কথা বলছি না, সংগঠনের মধ্যে নীতি-নির্ধারক দলনেতৃত্বের কথা বলছি। আমার দ্বিতীয় কথা, পশ্চিমবঙ্গে নমশূদ্র, দলিত, রাজবংশী এবং আদিবাসী নেতাদের দলের মধ্যে মাঝারি ও উঁচুস্তরে আনতে হবে। কেরলে শ্রেণিসংগ্রামে বাম দল সমাজের জাতিবিভাজনকে উপেক্ষা করে না, কাজে লাগায়।
প্র: বামেরা ভোটে হেরেছেন। কিন্তু ওঁদের ছেলেমেয়েরাই রেড ভলান্টিয়ার হিসেবে গোটা রাজ্য জুড়ে খুব ভাল ভাবে কাজ করেছেন। এই সামাজিক কর্মযজ্ঞ কি বামেদের ভোটারের মন ফেরাতে সাহায্য করতে পারে?
উ: হ্যাঁ, রেড ভলান্টিয়াররা মোটর সাইকেলে করে গিয়ে হঠাৎ যেটা দরকার পৌঁছে দিচ্ছেন, এই পরিষেবাটা শুনেছি খুব জনপ্রিয় হয়েছে। এটা আরও বড় মাপে করা উচিত। আরও কিছু সামাজিক কাজের কথা ভাবা যায়। যেমন অতিমারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুশিক্ষা-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় বামপন্থী স্বেচ্ছাসেবীরা যেখানে সম্ভব আন্তর্জাল মারফত, অন্যত্র মাঠে বা ক্লাবঘরের আঙিনায় বাচ্চাদের নিয়ে ক্লাস করতে পারেন।
প্র: বাংলায় জমি তো খুব বড় একটা ফ্যাক্টর। বামফ্রন্ট ভূমি সংস্কারের ফল পেয়েছে হাতেনাতে। মমতাও ফল পেয়েছেন সিঙ্গুর আন্দোলনের। সাধারণ কৃষক বা ভাগচাষির মন পেতে বামেদের কিছু করণীয় আছে?
উ: ভূমিসংস্কারের আগুনটা এখন নিবে আসছে। এর একটা বড় কারণ— ঘনবসতির জন্য জমির আয়তন ক্রমশ খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দরকার হচ্ছে সমবায়ের মাধ্যমে সার, বীজ ইত্যাদি কেনা। এবং সমবায়ের মাধ্যমে বিপণন। তাতে চাষির অনেক বেশি লাভ হয়। এই সমবায়টা কথায় হয়তো বলেন, কিন্তু বামপন্থীরা করে দেখাননি। ভারতে সফল সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলি গাঁধীবাদী ও অন্যদের নেতৃত্বে হয়েছে, বামপন্থীদের নেতৃত্বে নয়। যেখানে সম্ভব পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা অন্তত কয়েকটি সফল সমবায়ের দৃষ্টান্ত যদি করে দেখাতে পারেন, তা হলে তাঁদের উপর লোকের ভরসা জাগে।
বামপন্থীরা এক সময় বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে গর্ব করতেন। মমতা এখন পঞ্চায়েত থেকে সরে যাচ্ছেন, প্রায়শই বিডিওর হাতে এখন অনেক বেশি ক্ষমতা। এর কারণ পঞ্চায়েতে অনেক দুর্নীতি, প্রচুর টাকা তছরুপ হয়। এটার ফলে স্থানীয় গণতন্ত্রের থেকে সরে আসা হচ্ছে। বামপন্থীরা এটাতে আপত্তি করে বলতে পারেন— না, ওই দুর্নীতিটা আমরা বন্ধ করব। বামপন্থীদের হাতে যে পঞ্চায়েতগুলি এখনও আছে, সেইখানে এটা করে দেখানো হোক।
প্র: মমতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করেন। বামেরা এটাকে সামনে রেখে এর বিরুদ্ধে কতটা সরব হতে পারেন?
উ: পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বাম জমানায় কম ছিল না। পাইয়ে দেওয়ার জিনিস হল, অর্থনীতিতে যাকে বলে ‘প্রাইভেট গুড’ বা ব্যক্তির জিনিস। বামপন্থীরা লোকের মনোযোগ পাবলিক গুড বা সর্বজনীন সেবার দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করতে পারেন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ, বিদ্যুৎ, রাস্তা, সংযোগব্যবস্থা বা কানেক্টিভিটি ইত্যাদি।
প্র: আর বেকারত্বের সমস্যা! সিপিএম কিন্তু ভোটের আগে এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখে পথে নেমেছিল।
উ: সমস্যাটির অনেক দিক। কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার অনেক সময় বড় শিল্পের অনুসারী। পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্প দাঁড়াতে পারেনি, তার অনেক কারণ আছে। আমি বলব ইদানীং কালের সবচেয়ে প্রধান দুটো কারণ— প্রথমটা পরিকাঠামো, অর্থাৎ রাস্তা, বিদ্যুৎ, সংযোগব্যবস্থা ইত্যাদি। দ্বিতীয়টা নিয়ে লোকে খুব একটা জোর দেয় না, বামপন্থীরা সেটার উপর জোর দিতে পারেন— সেটা হচ্ছে স্কিল বা কর্মকুশলতা এবং ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ, এটার জন্য দরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষা। জার্মানি এর বড় উদাহরণ। ওরা বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার পর ব্যবসায়ী বা যাঁরা কাজ দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
প্র: ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধিতা, নব্য উদারবাদ নিয়ে ঠাট্টা— এগুলি বামপন্থীরা নানা সময়ে লঘু-গুরু ভাবে করে এসেছেন। কিন্তু এর বিকল্পটা কি বাংলার বামপন্থীরা আজ ভাবতে পারছেন?
উ: হ্যাঁ, বামপন্থীদের সব সময়ে দেখি বড় বড় বুলি, কিছু হচ্ছে না কেননা ধনতন্ত্র সমস্যাসঙ্কুল, এ ছাড়া ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’, নব্য উদারনীতি, ইত্যাদি— এই সব বড় বড় কথায় সাধারণ মানুষের চিঁড়ে ভেজে না। যদি সত্যি তোমরা ধনতন্ত্রকে অপছন্দ করো, ঠিক আছে ভাল কথা। কিন্তু ধনতন্ত্রের বিকল্প অ-ধনতান্ত্রিক একটা প্রতিষ্ঠান তোমরা করে দেখাও, যাতে ভাল ফল পাচ্ছ। বামপন্থীদের প্রধান ঝোঁক হচ্ছে রাষ্ট্রীয়করণ, কিন্তু রাজ্যে রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির যা দশা, তাতে লোকে ভরসা পায় না। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলির আন্দোলন স্বল্পসংখ্যক সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মাইনে বাড়াবার। বেশির ভাগ অসংগঠিত বা স্বনিয়োজিত শ্রমিকদের তাতে হিল্লে হয় না। বামপন্থীদের অনেক বেশি জোর দিতে হবে সমবায় এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের ঋণ, বিমা এবং বিপণনব্যবস্থাকে মজবুত করার চেষ্টায়। শ্রমিক আন্দোলনের ঝোঁকটাকে প্রধানত ওই দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে।