বিপদ শুধু গণমাধ্যমের নয়, গণতন্ত্রের

আমাদের ইতিহাসে ফোনে আড়ি পাতার উদাহরণ অনেক আছে। এই রকম আড়ি পাতার ঘটনায় কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী রামকৃষ্ণ হেগড়েকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তারপরে নীরা রাদিয়ার কথা রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল, সেটা নিয়েও একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। পেগাসাসের সফটওয়ার যে এরা ব্যবহার করছে তা আমরা ২০১৯-এই জানি। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের কম্পিউটারে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং বিস্মিত হবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সরকার বারংবার কেন বলছে আমরা আইন মেনে চলছি? যদি আইন মানো তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সচিবের অনুমতি নিয়ে এই কাজ করেছ?

পেগাসাস স্পাইওয়্যার প্রচুর টাকার ব্যাপার, যে কেউ কিনতে পারবেন না। আর, পেগাসাস আমাদের বিক্রিও করবে না। সরকার ও সরকারি সংস্থাকেই কেবলমাত্র বিক্রি করবে। আজ পর্যন্ত ভারত সরকার বলছে না এই সফটওয়্যার কিনেছে কি না— হ্যাঁ , না বলছে না। কিনলে কে কিনেছে, কত পয়সা দিয়েছে, এই পয়সা নাগরিকদের করের টাকা। নাগরিকের করের টাকায় তদের ওপরেই গুপ্তচরবৃত্তি হচ্ছে। 

ফরবিডেন স্টোরিজ ফ্রান্সের একটি ওয়েবসাইট। অ্যামেনস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি সিকিউরিটি ল্যাব আছে। ১৭ টি সংস্থা মিলিতভাবে ৪৫ টি দেশে অনুসন্ধান করেছে। এ কোনও ছোটখাট ব্যাপার না। ভারত ছাড়াও আজারবাইজান, বাহরিন, কাজাখস্তান, মরক্কো, সৌদি আরব, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে এই নজরদারি করা হয়েছে। আমাদের সরকার বলছে, বিনা অনুমতিতে কিছু করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত ৪৯ জন সাংবাদিকের নাম জেনেছি। আরও কাদের নাম আছে, তা ধীরে ধীরে জানা যাবে। মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, কোনও জজসাহেবের নাম থাকবে কিনা, তা জানা যাবে। যে সাংবাদিকদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে তাঁদের প্রোফাইল দেখুন। তাঁরা অন্য সাংবাদিকদের মতো নয় যে কেবল সরকারের গুণগান করে যাচ্ছে, তাঁরা নিজেদের কাজ করছেন। তাঁরা বিজ্ঞাপন এজেন্সি, পিআরও-র কাজ করছেন না। আমাদের গণমাধ্যমের এক বড় অংশ এখন কেবল সরকারকে প্রশংসা করে, বিরোধীদের নিন্দা করে, সরকারের গুণগান রোজ গাইছে। অল্প কিছু সাংবাদিক আছেন যাঁরা সরকারকে এখনও প্রশ্ন করছেন। তাঁদের ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। 

সরকার যেমন বলছে আমরা বেআইনি কিছু করিনি, তেমনই পেগাসাসের নির্মাতা এনএসও একই দাবি করছে। এনএসও শাসাচ্ছে ফরবিডেন স্টোরিজের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবে। এনএসও’র ওয়েবসাইটে বলা আছে কেবল সরকারি সংস্থা কিনতে পারবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিনতে পারবে। মাদক পাচারকারী, শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনকারী এদের বিরুদ্ধে এই সফটওয়্যার কাজে লাগে। সাংবাদিকরা কি অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী. দেশদ্রোহী? 

আমি মনে করি আমাদের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া উচিত। আদালত নেবে কিনা, তা পৃথক প্রশ্ন। যৌথ সংসদীয় তদন্ত হওয়া উচিত , স্বাধীন তদন্ত। কারা এই সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। কে সত্য বলছে, কে মিথ্যা বলছে তা নিরপেক্ষ ভাবে অনুসন্ধান হওয়া উচিত।

এ বছর মার্চে সন্ধ্যা রবিশঙ্কর নামের এক মহিলা ফরবিডেন স্টোরিজের প্রতিনিধি হিসাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান করছি, তাতেই দেখা গেছে আপনার ফোন ওরা ট্যাপ করছে। আমরা যদি একটা কপি করতে পারি তাহলে ক্লাউডে দেখব। এর পরে আরেকজন ফরাসি জুনিয়াস লুকার্ট ও আরও কয়েকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। ওরা বলল আমরা ফরেনসিক বিশ্লেষণ করব। আমি জনস্বার্থে সেই অনুমতি দিলাম। ওরা প্রায় দেড় মাস ধরে সেই বিশ্লেষণ করেছে। তারপর বলল, ২০১৮-র মার্চ—এপ্রিল- মে মাসে তোমার ফোন ট্যাপ করার চেষ্টা হয়েছে। আই ফোন হওয়া সত্ত্বেও ওরা ঢুকতে পারে। ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল ওই সময়টায় আপনি কী নিয়ে লিখছিলেন, কী নিয়ে তদন্ত করছিলেন। আমি বললাম একটা বিষয় হচ্ছে প্রয়াত খ্যাতনামা পুঁজিপতি ধীরুভাই আম্বানির সম্পত্তি কীভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, ট্যাক্স হেভেনে স্থানান্তর হয়েছিল তা নিয়ে। এ নিয়ে তাঁর বড় ছেলে মুকেশ আম্বানি এবং ছোট ছেলে অনিল আম্বানিকে লম্বা ই-মেল পাঠিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া চাই। তাঁরা কোনও জবাব দিলেন না। ২০১৮-র মে মাসে নিউজক্লিক একটা বড় লেখা প্রকাশ করে। আরেকটা বিষয় নিয়ে আমি ওই সময়ে কাজ করছিলাম। ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ কীভাবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির স্বার্থে অপব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে। আড়ি পাতার কাজ যে পেগাসাস দিয়ে হয়েছে তা আমি জানতাম না। এটা গতকাল প্রকাশিত হবার পরে জানলাম। 

যা হয়েছে তা শুধু গণমাধ্যমের জন্য নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। শুধু প্রাইভেসির ব্যাপার নয়, এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। গণতন্ত্র কোন বিপদের মুখে, তা দেখিয়ে দিয়েছে। 

(অনুলিখনের ভিত্তিতে)