পাঞ্জাবে ভোট হয়ে গেল। দেখা গেল ভোটদানের হার গত কয়েক বছরের হিসেবে সর্বনিম্ন। বিশেষত আপ যে অঞ্চলগুলিতে ভালো সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করেছিল, পরিসংখ্যান জানাচ্ছে মূলত সেই অঞ্চলগুলিতেই প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা অপ্রত্যাশিত রকমের কম। যে সব অঞ্চলে আম আদমি পার্টির বিধায়ক রয়েছে, সেই অঞ্চলগুলিতেও ভোটদানে অনীহা ছিল চোখে পড়ার মতো।
মাসখানেক আগেও মনে করা হচ্ছিল এই নির্বাচনে কংগ্রেস বড় ব্যবধানে জয়ী হবে। তার অনেকগুলি কারণ ছিল। বিশেষত কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পাঞ্জাবের নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। একমাত্র বিজেপি ছাড়া পাঞ্জাবের প্রত্যেকটি দল সমর্থন করেছে এই আন্দোলন। এমনকী শিরোমণি আকালি দল, বিজেপির সঙ্গে যাদের বছর তিরিশেকের জোট, তারা পর্যন্ত এনডিএ-র সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বছর খানেক আগে। ভারতীয় জনতা পার্টির সবথেকে পুরনো সহযোগী ছিল আকালি দল। যদিও সম্পূর্ণ যাত্রাপথ খুব একটা মসৃণ ছিল না। তবে জোট ভেঙে বেরিয়ে আসার ঘটনা এই প্রথম।
২০২০ সালের জুলাই মাসেই শিরোমণি আকালি দলের সুখদেব সিং ধিন্ডসা, সেওয়া সিং শেখওয়ান সহ বহু নেতা লুধিয়ানার একটি গুরুদ্বারে বৈঠক করেন শিরোমণি আকালি দল (তক্সালি)-এর সঙ্গে। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে গড়ে ওঠে শিরোমণি আকালি দল (ডেমোক্রেটিক)। এর সভাপতি হন সুখদেব সিং ধিন্ডসা। ফলত দলের সমর্থকদের মধ্যেই নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আকালি দলে এই ডেমোক্রেটিক অংশ সুখদেব সিং-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং-এর সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। ডিসেম্বরে এই দু'জন দেখা করেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব–অমিত শাহ এবং জেপি নাড্ডার সঙ্গে। সুখদেব-অমরিন্দর এবং বিজেপি জোটের ভালো ফলের আশা একেবারেই নেই এই নির্বাচনে, মনে করছেন ভোট বিশেষজ্ঞরা। এমনকী খুব বেশি আসন পাবে না এসডিএ-ও, মত পর্যবেক্ষকদের। আকালি দল বরাবরই প্রচণ্ড কংগ্রেস বিরোধী। তার উপর শুরুতে বিজেপির কৃষিবিলকে তারা সমর্থনই করেছিল। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে আর কংগ্রেসের সুযোগ বাড়ছে--এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল।
পাঞ্জাব নির্বাচনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী আপ তাদের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোষণা করেছিলেন, টেলিফোনিক পোলের মাধ্যমে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী বেছে নেবেন। ১৮ জানুয়ারি এই পোলিং-এ ২১ লক্ষ প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান ভগবন্ত মানের নাম উঠে আসে। ভগবন্ত সিং মান ২০১৪ সালের মে মাসে পাঞ্জাবে আপের সাংসদ হয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রার্থীকে নিয়েই তুমুল বিতর্কের মুখে পড়তে হয় আপ-কে। আপ থেকে বহিষ্কৃত সাংসদ হরিন্দর সিং খালসা তাঁর ৪৯৫ নং সিটটি পরিবর্তনের অনুরোধ করে স্পিকারকে চিঠি দেন ২০১৬ সালের জুন মাসে। অভিযোগ ছিল, মানের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসে, তাই তাঁর পাশের আসনে বসতে অত্যন্ত অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। মান এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অনৈতিক বলে দাবি করেন। মানই আবার ২০১৯ সালে প্রকাশ্য মিটিংয়ে শপথ করেন পার্টির ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তিনি মদ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন। কয়েকদিন আগে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরঞ্জিত সিং চান্নি দাবি করেন, “২০১৯-এ দেওয়া কথা মোটেও রাখেননি মান। এমনিতেই প্রায়শ তাঁকে মাতাল অবস্থায় দেখা যায়। মুখ্যমন্ত্রী হলে সন্ধে ছ'টার পর তাঁর আর পাত্তাই পাওয়া যাবে না।” মানও কম যান না। দিন কয়েক আগেই ১৬৯ কোটির সম্পত্তি নিয়ে চান্নিকে কটাক্ষ করেছিলেন মান।
এই সমস্ত বাদানুবাদ সামনে রেখেই মনে করা হচ্ছিল এবার পাঞ্জাব নির্বাচনে জিততে চলেছে কংগ্রেসই। দ্বিতীয় স্থান দখল করবে আম আদমি পার্টি আসবে, তৃতীয় স্থান আকালি দল এবং চতুর্থ স্থানে সুখদেবের সঙ্গে অমরিন্দর ও বিজেপির জোট এলেও আসতে পারে।
কিন্তু গত দু'মাসে তুমুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভুগছে কংগ্রেস। সেই কারণেই পাশা খানিক হলেও উল্টে গিয়েছে। সুনীল জাখরকে নিয়ে বিতর্ক দিয়ে এর শুরু। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীদের তালিকা থেকে নির্বাচনের প্রাক্কালে বাদ পড়েন জাখর। জাখর একজন পাঞ্জাবি জাঠ। তাঁর বাবা বলরাম জাখর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯–দশ বছরে পরপর দু'বার লোকসভার স্পিকার হিসাবে নির্বাচিত হন বলরাম। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপালও ছিলেন বলরাম জাখর। কাজেই কংগ্রেসের একাংশ মনে করছিল, তাঁর পুত্র সুনীল জাখরকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে ভাবা সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু শেষমেশ তা হয়নি। জাখরের বয়ান অনুযায়ী কেবলমাত্র শিখ নন বলে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে কংগ্রেস নেতৃত্ব।
দীর্ঘদিন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীদের এই শিখ পরিচিতি নিয়ে কোনও কথা ওঠেনি। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে এই বিতর্কে সরগরম পাঞ্জাব। সত্যিই স্বাধীনতার পর থেকে বৃষ ভান, গোপি চাঁদ ভার্গব, ভীম সেন সাচার এবং রাম কিশান–এই কয়েকটি ব্যতিক্রমের বাইরে পাঞ্জাবের যাবতীয় মুখ্যমন্ত্রী শিখ। ১৯৬৬ সালের পর থেকে শিখ নন–এমন কোনও প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী হননি। সেক্ষেত্রে শিখ মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দরকে কেন সরিয়ে দিল কংগ্রেস?
রাজনৈতিক মহলের মত, দল বুঝেছে যে অমরিন্দরের জনপ্রিয়তা প্রায় পড়তির দিকে। অমরিন্দরের বাবা ইয়াদোবিন্দর সিং ছিলেন পাটিয়ালার শেষ মহারাজা। সে সূত্রে যুবরাজ অমরিন্দরের একটা রাজকীয় চলনবলন রয়েছে। কিন্তু আমজনতা মনে করে রাজা রাজারাদের যুগ আর নেই, যদিও এ কারণেই এককালে অনেকেই পছন্দ করত তাঁকে। অমরিন্দরের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ, ক্ষমতায় থাকাকালীন শিরোমণি আকালি দলের বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, কিছুই নেননি তিনি। আকালি দলের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের অভিযোগ প্রচুর। কাজেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল মানুষ। অনেকে আবার বলেন, অমরিন্দরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কিত গুজবের ভিত্তিতে বিজেপি ক্রমাগত ব্ল্যাকমেইল করেছে তাঁকে। বহুদিন থেকেই পাকিস্তানের সাংবাদিক আরুসা আলমের নামের সঙ্গে জড়িয়ে নানা কথা রটছিল। প্রথম প্রথম তা অস্বীকার করলেও পরে সম্পর্কের ব্যাপারটা স্বীকার করে নেন দু'জনেই। আরুসা আইএসআই-এর এজেন্ট—বিজেপি এমন একটা ধুয়ো তুলেছিল তখন। নিন্দুকরা প্রায়ই কটাক্ষ করে বলেন, অমরিন্দর যা রসেবশে থাকেন, তাতে পদে না থাকলেও তাঁর আর কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়। তিনি রোস্ট-ল্যাম্ব, হুইস্কি সহযোগে বাকি জীবন আনন্দে কাটিয়ে দেবেন। কুর্সিতে থাকাকালীন অমরিন্দর ছিলেন ভারতের প্রবীনতম মুখ্যমন্ত্রী। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৯। এ বয়সে তাঁর কর্মতৎপরতা নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছিল কংগ্রেসের ভিতর।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে নাটকীয় ভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেন অমরিন্দর। সেদিনই পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নভজ্যোত সিং সিধুর সঙ্গে তাঁর বিরোধের কথা অনেকেরই জানা। উনিশ বছর ভারতীয় ক্রিকেট টিমের হয়ে খেলেছেন সিধু। পরে ২০১৪ নাগাদ বিজেপিতে যোগ দেন। কপিল শর্মার কমেডি শো-তেও স্থায়ী অতিথির ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে। ২০১৬ নাগাদ বিজেপি ছেড়ে আসেন কংগ্রেসে। গত বছর জুলাই মাসে তাঁকে পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি করেন সোনিয়া। এতে মত ছিল না অমরিন্দরের। এরপরেই সিধুর অনুগামী একাধিক মন্ত্রী ও বিধায়ক অমরিন্দরের অপসারণের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন। সেপ্টেম্বর মাসে অমরিন্দরকে সরিয়ে দেওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন–এই নিয়ে তীব্র মতান্তর শুর হয়। তবে তার মধ্যেই দলিত শিখ প্রার্থী চরঞ্জিত সিং চান্নিকে মুখ্যমন্ত্রী করে কংগ্রেস হাইকমান্ড।
পাঞ্জাবকে সাধারণত তিনটে অঞ্চলে ভাগ করা হয়। দোয়াবা, মালওয়া এবং মাঝা - এই তিনটে অংশেই শিখ-দলিতদের সংখ্যা প্রচুর। এই বিশাল সংখ্যাক ভোটারদের সামনে রেখেই আকালি দলের সঙ্গে পাঞ্জাবে বহুজন সমাজবাদী পার্টির জোট হয়েছে। বিখ্যাত দলিত রাজনীতিবিদ কাশীরামের বিপুল প্রভাব ছিল পাঞ্জাবে। ফলত, দলিত ভোটের গুরত্ব নির্বাচনে অপরিসীম।
প্রসঙ্গত, চান্নি পাঞ্জাবের প্রথম দলিত-শিখ মুখ্যমন্ত্রী। চান্নিকে কংগ্রেস হাইকমান্ড মুখ্যমন্ত্রী করার পর থেকেই সিধুর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় তাঁর।
অবস্থা চরমে পৌঁছলে প্রকাশ্য সভা করে দু'জনেরই সমালোচনা করেন রাহুল। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের পরিষ্কার ঘোষণা করে জানানোর সুযোগ ছিল যে দলের কোনও মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী নেই। নির্বাচন জিতলে, দল ঠিক করবে কে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসবে। এতে বিতর্ক বাড়ত না। বরং জেতার একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকত কংগ্রেসের। কিন্তু তা না করে শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের দোলাচলকেই সামনে এনেছে। বারবার চান্নি ও সিধুর ঝগড়ায় শীর্ষনেতৃত্বের প্রকাশ্য সমস্যা দ্বিধায় ফেলেছে দলের সমর্থকদেরও।
অবশ্য কংগ্রেস সুযোগের সদ্ব্যবহার না করতে পারায় এবার আপের খানিকটা সুবিধা হয়ছে। এ কথা ঠিক, এই নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আপের। শেষ পর্যন্ত ভগবন্ত সিং মান নাকি চরঞ্জিত সিং চান্নি, কে হবেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী? এ প্রশ্নের উত্তর পাঞ্জাবের আমজনতা দিয়েছে। ১০ মার্চ জানতে পারব আমরা।