মণিপুরে যে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে, এ তো অস্বাভাবিক ছিল না। মেইতেই, কুকি আর নাগা, এদের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব তা তো আজকের না। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মণিপুর এই দ্বন্দ্বে জেরবার। মণিপুর রাজ্যের অর্ধেকের একটু বেশি সংখ্যার মানুষ ইম্ফলের উপত্যকায় থাকে, যেখানে লোকটাক হ্রদটির অবস্থান। পাহাড়ে থাকেন প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ। এই মানুষরা মূলত কুকি এবং নাগা, তাঁদের বেশিরভাগই ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী এবং তপশিলি জাতি। যখন মণিপুর হাইকোর্টের বিচারক মুরলিধরন বললেন, মেইতেইদেরও এই অনুসূচির জনজাতির তালিকাতে আনা হবে, সেই থেকেই মূল সমস্যার সূত্রপাত। ১৮ মে দেশের শীর্ষ আদালত জানায় বিষয়টা অসাংবিধানিক।
এই সমস্তটা শুরু হয়েছে চলতি বছরের মে মাসের ৩ তারিখ। জুলাই মাস শেষের পথে। অর্থাৎ আড়াই মাসের বেশি ধরে এই হিংসা ও বিদ্বেষ চলছে। এই সময়কালে কম করে দেড়শো মানুষ মারা গেছেন। ৫০ হাজারের উপর মানুষ শরণার্থী হয়েছেন তাঁদের নিজেদেরই রাজ্যে, নিজেদেরই দেশে। আরও ভয়াবহ একটি বিষয় হলো, সাড়ে ৩ হাজারের বেশি বন্দুক লুট হয়েছে। ৭৫০ বন্দুক ফেরত এসেছে আবার। কিন্তু পরিসংখ্যানই যথেষ্ট ভীতিপ্রদ! একদিকে ৩,৫০০ অন্যদিকে ৭৫০! একটা রাজ্যের আইন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে, আর তা ভেঙেছে সবার চোখের সামনেই। রাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অপারগ! বাইরে থেকেও সেনা আনা হলো, তারাও কিছুই করতে পারছে না। আমাদের কেন্দ্র সরকার কী করছে?
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের অবস্থানে সামান্য বদলটুকুও আসেনি কেন্দ্রের তরফে। নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের সময় মণিপুর সফর করেছেন প্রবল। ভোট এলে তিনি ছোট রাজ্য, বড় রাজ্য সর্বত্র ঘন ঘন চলে যান ঠিকই, তবে এবারে তিনি আর ওপথে যাননি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুর গেছেন। কিন্তু তাঁর সফরের পরেও অবস্থা পাল্টায়নি, বরং ভয়াবহ দিকে গিয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে এই ভিডিওটি, ভারতবর্ষের মানুষের মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ার পর ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী চোখ মেলে চেয়েছেন। ৭৮ দিনের নীরবতা ভেঙে ৩৬ সেকেন্ড কথা বললেন মোদি। বললেন এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়, নাগরিক হিসেবে সবাই লজ্জিত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারপরই প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে পুরো বিষয়টির মধ্যে রাজনীতি নিয়ে এলেন।
মোদি বললেন, এই ধরনের ঘটনা যদি রাজস্থানে হয়, ছত্তিশগড়ে হয় তাহলে তারও নিন্দা করা উচিত। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরেও প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি ভুলতে পারলেন না। রাজধর্ম পালন তো দূরের কথা! কয়েক মাস পরেই রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন হবে। আর পশ্চিমবঙ্গে যখন ঘটনাটি ঘটল, মালদহ জেলায়, তা নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির হই হুল্লোড় চোখে পড়ার মতো। যে ঘটনা ভারতের প্রত্যেক মানুষকে, প্রত্যেক মহিলাকে লজ্জিত করেছে, তা নিয়েও কেন্দ্র রাজনীতি করছে! এ ভাবা যায় না! অথচ কোনও ক্ষতিই হতো না যদি নরেন্দ্র মোদি বলতেন, বীরেন সিং তুমি পদত্যাগ করো। কেন বলছেন না? ওই ৩৬ সেকেন্ড ছাড়া মোদির মুখের কুলুপটি খোলেনি। ভারতীয় হিসেবে আমরা লজ্জিত তো বটেই কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতের ছবিখানি সারা বিশ্বের কাছে যেভাবে নগ্ন হয়েছে, সেটা? আমার মনে হয়, বহু বহু কাল পরে এমন দিন এল।
অনেকদিন পর আমার দেশের এমন চেহারা দেখছি। মণিপুর বড্ড ছোট একটা রাজ্য। কিন্তু বাইরের দেশের চোখে? বিদেশের সকলে তো জানেন না ভারতের মানচিত্র কেমন! অন্য দেশ জানে না, মণিপুর উত্তরপূর্বের এক রাজ্য, মায়ানমারের সঙ্গে এই রাজ্যের ৪০০ কিলোমিটার লম্বা এক সীমান্ত রয়েছে, সেখানে আফিমের ব্যবসা চলে! বিশ্ব তো দূরের কথা, আমাদের দেশের নাগরিকরাই বা কতটা জানে? কিন্তু ওই যে ভিডিওটি, দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো- সেটি তো মূল ঘটনার আড়াই মাস পর! হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী এমনভাবে বলছেন, যেন তিনি কিছুই জানেন না। থানায় ডায়েরি হয়েছে, তিনি জানেন না!
এই ঘটনার প্রভাব মণিপুরের বাইরে, ভারতের সমগ্র উত্তরপূর্ব এলাকার বাইরে এবং বিশ্বে আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের মাথা নিচু করে দিয়েছে। আমাদের দেশে এমন ঘটনা ঘটে এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী ৩০ সেকেন্ড কথা বলে আর কিছু বলছেন না। আমাদের সংসদ বন্ধ কারণ নেতারা কথা বলতে চান না। তারা কেবল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মণিপুর থেকে পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় টেনে আনেন। কিন্তু মণিপুরের বেলা চুপ।
আমরা জানি মেইতেইরা অধিকাংশই হিন্দু। কুকি নাগারা ক্রিশ্চান ধর্ম পালন করেন। ওই এলাকায় অনেক চার্চ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এর প্রভাব ভবিষ্যতে ভারতের রাজনীতির উপর পড়বেই। মোদির ভাবমূর্তি আরও খারাপ হবে নির্বাচনের আগে। এখনও সময় আছে, এখনও মুখ খুলতে পারেন তিনি। এখনও বীরেন সিংকে পদত্যাগ করতে বলতে পারেন। সে সব আদৌ করবেন কিনা জানা নেই। এটা প্রধানমন্ত্রীর মোদির বোকামো! তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ভালোই হতো যদি তিনি মণিপুর নিয়ে মুখর হতেন, সংসদে কথা বলতেন, যদি আরও শক্ত হতেন। তাঁর নিজের রাজনৈতিক মূর্তিটাই উজ্জ্বল হতো।
দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কড়া পদক্ষেপ করলে সারা বিশ্বে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়াটিই গাঢ় হতো। নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী, অথচ তিনি মুখ খুললেন না। বদলে যা যা হলো, তাতে সমস্ত নাগরিকের মাথা নত হয়ে গেল। বিজেপি এখনও মোদির 'ইমেজে' ভরসা রাখে। তবে যখন কেউ ক্ষমতার দম্ভে অত্যধিক অহঙ্কারী হয়ে যায়, তাঁর বুদ্ধি কমে যায়। নরেন্দ্র মোদির বুদ্ধির অভাব সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল।