এমন একজন মহিলার বিষয়ে আজ কথা বলব, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন বয়স হতো ৬২। ওঁর জন্মদিন ২৯ জানুয়ারি, ১৯৬২। তবে বছর ছয়েক আগে, ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে তাঁর নিজেরই বাড়ির সামনে একটি লোক মোটরসাইকেলে এসে গুলি করে মেরে ফেলে। ওঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল সেটি, বেঙ্গালুরুর রাজারাজেশ্বরী নগরে। গৌরী লঙ্কেশ নেই, ছয় বছর হয়ে গেল! গৌরী শুধু তো একজন দাপুটে মহিলা, একজন অসাধারণ সাংবাদিকই ছিলেন না। নিজের নামে, গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে প্রকাশ করতেন কিন্তু কেবল 'সাংবাদিক' বললে কিছুই বলা হয় না গৌরী সম্পর্কে। গৌরী সমাজকর্মী ছিলেন। দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন গৌরী, লড়েছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে।
কিছু লোক অবশ্য শুধু এটাই মনে করেছিলেন যে, গৌরী একজন মহিলা এবং হিন্দু ঘরেরই সন্তান। গৌরীর বাবা পি লঙ্কেশ খুবই বিখ্যাত মানুষ। কন্নড় ভাষার অধ্যাপক ছিলেন তিনি, কবি ছিলেন, নাটক লিখতেন। পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সিনেমা বানিয়েছেন। তাঁর কন্যা, তিনি আজীবন লড়েছেন এমন গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে যারা দাবি করে তারা নাকি হিন্দুধর্মকে রক্ষা করছে। মুসলমানদের থেকেও তাদের কাছে এই মহিলা ভয়ানক, কারণ গৌরী একজন হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও এই হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কে হত্যা করল গৌরীকে? কর্ণাটক পুলিশ ও মহারাষ্ট্র পুলিশ একসঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছিল। পুলিশ গৌরী লঙ্কেশ খুনের ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে। এই ছয়জনের মধ্যে একজন ছিল পরশুরাম ওয়াগমারে। কর্ণাটক পুলিশের অভিযোগ, সে-ই হত্যা করেছিল মূল। বাকিরা এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ছয়জন একটি সংস্থার লোক, শ্রী রাম সেনি। কর্ণাটকের উপকূলীয় অংশেই এই সংস্থাটি আছে। শুধু কর্ণাটক নয়, গোয়া, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশে শ্রী রাম সেনি আছে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা সকলকে বোঝায়, যারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু মুসলমান আর কিছু চরম বামপন্থীরা কাজ করছে। তাঁদেরই একজন গৌরী লঙ্কেশ।
আগেও বলা হতো, তবে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বারেবারে একটা কথা উঠে এসেছে, হিন্দু খতরেঁ মে হ্যায়! ভারতবর্ষ ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। শেষ জনগণনায়, মানে ২০১১ সালের পর তো জনগণনাই হয়নি, তাতে দেখা গেছে, এই দেশের ৮২ শতাংশ মানুষই হিন্দু। ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ মুসলমান। সংখ্যাগরিষ্ঠ যেখানে হিন্দু, সেই দেশে হিন্দুরাই খতরেঁ মে হ্যায়? গৌরীর হত্যার ওই একই বছরে কন্নড়ভাষী আরেকজন সাহিত্যিক এম এম কালবর্গিকেও হত্যা করা হয়। গৌরী হত্যার দু' বছর আগে মহারাষ্ট্রে গোবিন্দ পানসারেকেও হত্যা করা হয়, ২০১৫ সালে। আরও ২ বছর আগে মারাঠীভাষী নরেন্দ্র দাভোলকারকে হত্যা করা হয়। এই প্রত্যেকজনই নিজেদের বলতেন যুক্তিবাদী। অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন তাঁরা। এঁরা সবাই বামপন্থী দলের সঙ্গে সরাসরি না থাকলেও নিজেদের বামপন্থীই বলতেন। ২০১৩, ২০১৫ এবং ২০১৭- দুই বছরের ব্যবধানে এই তিনটি হত্যা ঘটে। অনেকেই মনে করেন, এই ৩ জনকে যারা হত্যা করে তারাই গৌরীকেও হত্যা করে।
আমি নিজে দেখেছি, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে, 'সব মুসলিম সন্ত্রাসবাদী নয়, তবে সব সন্ত্রাসবাদীই মুসলমান’। এটা অনেকেই বিশ্বাস করে। হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটির থেকে যারা শিক্ষা পায়, তারা ঠিক এইটাই বিশ্বাস করে। মুসলমানের জন্যই হিন্দুরা খতরেঁ মে হ্যায়। গৌরী লঙ্কেশের কিন্তু পয়সার অভাব ছিল না কোনওদিনই। টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন গৌরী। দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতা করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর গৌরী ভাবলেন, বাবা যে পত্রিকা করেছেন, সেটিকেই নতুন করে চালিয়ে নিয়ে যাবেন তাঁরা। পরিবারে বিপুল সমস্যা তৈরি হয়। গৌরীর ভাই নরেন্দ্র মোদির পক্ষে চলে যান। বিজেপিতে যোগদান করেন। গৌরী তখন নিজের নামেই পত্রিকা শুরু করেন। জনপ্রিয় হয় গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মতো কাগজ তো বিজ্ঞাপন ছাড়া চলতেই পারে না। সাংবাদিকরা মাইনেই পাবেন না বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেলে। অথচ একটিও বিজ্ঞাপন নিতেন না গৌরী। অনুদান নিতেন। তাতেই চলত কাজ। প্রচণ্ড আদর্শবাদী মহিলা ছিলেন গৌরী। কিন্তু এইভাবে তো পত্রিকা চালানো মুশকিল। টাকা পেতেন না কিছুই। নিজেই শেষের দিকে লিখেছিলেন, "পারছি না চালাতে"। কাগজ কেনার টাকা, ছাপানোর টাকা, বিতরণের টাকা, যারা লিখছেন তাঁদের পারিশ্রমিক- কোনও টাকা নেই! তাও হাল ছাড়েননি। অথচ কন্নড় ভাষায় এমন পত্রিকা ছিল না আর।
গৌরীকে হত্যার পর বলা হলো, নকশালবাদী, চরম বামপন্থীদের সঙ্গে যোগ ছিল গৌরীর। তারাই গৌরীকে খুন করেছে। গৌরীর বিরুদ্ধেই উল্টে মানহানির মোকদ্দমা শুরু করে বিজেপির এক কার্যকর্তা। কোনও এক সোনার গয়না বিক্রেতাকে নাকি ভুল বুঝিয়ে ঠকিয়ে নেন গৌরী। যাদের জেল খাটতে হলো, যেমন পরশুরাম ওয়াগমারের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ছিল, আমোল কালে বলে একজন সাজা পায়, এদের চরম মগজ ধোলাই করা হয়। কম বয়সি ছেলে, বছর ২৬ বয়স ছিল তখন। হিন্দুধর্মকে বাঁচাতে হবে বলে নাকি গৌরী লঙ্কেশকে খুনই করে ফেলে সে! সেই বিচার এখনও চলছে আদালতে।
শেষ করার আগে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কয়েকটা কথা বলতেই হয়। গৌরীকে খুব ভালো করে চিনতাম। অন্তত বার পাঁচেক দেখা হয়েছে আমাদের। ওঁর সঙ্গে আমি একটা সাক্ষাৎকার করেছিলাম। আমি তখন কর্ণাটকের বেল্লারি জেলা আর পাশের অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলায় লৌহ আকরিকের বেআইনি খনন নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছিলাম, ১৩ বছর আগে। তারপর গালি জনার্দন রেড্ডির বছর তিনেক জেল হয়, কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পাকেও জেলে যেতে হয়। তিনি পরে আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যান। বিষয়টা হচ্ছে, দক্ষিণ ভারতের একটা রাজ্যেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির, বিজেপির শক্তি আছে, কর্ণাটকে। অন্ধ্রে প্রায় নেই, কেরল, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানায় নেই। গৌরী এই রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়ার দাম দিয়েছেন।
এই ধরনের মহিলা, এই ধরনের আদর্শবাদী চেতনা, এই ধরনের সাংবাদিককে দেশ হারিয়েছে। ইংরেজি ভাষা ছেড়ে ছেড়ে মাতৃভাষা কন্নড়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন গৌরী। তাঁকে হত্যা করা হলো। এই সাংবাদিকতা, এই আদর্শকে ভারতের সমস্ত নাগরিকের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। তাঁর আদর্শ যাতে বেঁচে থাকে সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। সম্প্রতি তিস্তা শীতলাবাদ একটা অনুষ্ঠান করেন বেঙ্গালুরুতে। সেখানে এই দেশে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা, বহু বিতর্ক হয়েছে। তবে একটা বিষয়ে আমরা সকলেই একমত হয়েছি। গৌরীর আদর্শ ভারতে প্রায় নিশ্চিহ্ন, সেই ঐতিহ্য আমাদেরই বাঁচাতে হবে, এই মুহূর্তে স্বাধীন সাংবাদিকদেরই এই দায়িত্ব নিতে হবে।