নির্বাচনী বন্ড- সবাই এখন সর্বোচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে

নির্বাচনী অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে সরকারের চালু করা নির্বাচনী বন্ড 'অসাংবিধানিক' বলে বাতিল  করেছে সুপ্রিম কোর্ট। গত ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ তাঁদের রায়ে বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন রাজনৈতিক দল কার থেকে কত টাকা চাঁদা পেয়েছে - তা  ৬ ই মার্চের মধ্যে জানাতে হবে। যেহেতু পুরো টাকাটা লেনদেন হয়েছে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে ফলে সেই তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব তাদের - ই। নির্বাচনে রায় দেন দেশের সাধারণ জনগণ সুতরাং এই  তথ্য জানার অধিকার তাঁদের সবার রয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনের ওয়েব সাইটের মত সর্বজনীন মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে হবে।

একটু জেনে নেওয়া যাক নির্বাচনী বন্ড কী ও কেন? নির্বাচনের অর্থ সংগ্রহ ও তা খরচের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে মোদী সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ড চালুর প্রস্তাব আনেন। যদিও প্রস্তাব পাশের পর নিয়ম তৈরি করতে ১১ মাস সময় লেগেছিল। যাই হোক, এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে-কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে কোনও রাজনৈতিক দলকে যত খুশি চাঁদা দিতে পারে । যে ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে চান, তিনি সেই বন্ড কিনতেন। দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়ত। কার কাছ থেকে কত টাকা চাঁদা মিলেছে, তা রাজনৈতিক দলগুলিকে জানাতে হত না। একই ভাবে কোনও কর্পোরেট সংস্থাকেও জানাতে হত না তারা কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা চাঁদা দিয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের সমস্ত কেনা বেচা হত স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল গুলো দলের ফান্ড বাড়াতে দফায় দফায় নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করেছে।

যেদিন এই বন্ড চালু হয় সেদিনই সরকারের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছিল, হিতে বিপরীত হবে না তো! স্বচ্ছতার পরিবর্তে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির জন্ম দেবে না তো! অর্থ দপ্তরের অফিসারদের একাংশ এবং রিজার্ভ ব্যাংকের সিনিয়র আধিকারিকদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন এই বন্ড সমান্তরাল অর্থনীতির জন্ম দেবে। এর বিরুদ্ধে  সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল দেশের নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে কোনোও অজানা কারণে তারা দারুণ ভাবে নিঃশ্চুপ।

নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে বেসরকারি সংস্থা 'অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস' ও 'কমন কজ়', সিপিএম ও কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর মামলা করেছিলেন। তাঁদের মূল অভিযোগ ছিল, বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা গোপনে যত খুশি টাকা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা হিসেবে দিচ্ছে। তার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করছে।  সাধারণ মানুষ এসবের কিছুই জানতে পারছেন না। শাসক দল নির্বাচনে সুবিধা পাচ্ছে।

রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট বা তথ্য জানার অধিকার আইনে সাধারণ মানুষের সব কিছু জানার অধিকার আছে। কমোডর লোকেশ, বাত্রা সহ আরো কেউ কেউ নির্বাচনী বন্ডের তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে অনেকগুলি আরটিআই করেছিলেন। তাতে নির্বাচনী বন্ডের যে তথ্য সামনে এসেছে তা হল, ৩০ দফায় স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে মোট ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২- ২৩-এই ছয় বছরে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি, প্রায় অর্ধেকেরও বেশি অর্থ পেয়েছে বিজেপি। গত ছয় বছরে বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৬,৫৬৪ কোটি টাকা চাঁদা পেয়েছে। কংগ্রেস পেয়েছে ১,১৩৫ কোটি টাকা। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে চাঁদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপি, কংগ্রেসের পরেই রয়েছে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল পেয়েছে ১,০৯৬ কোটি টাকা। একমাত্র রাজনৈতিক দল সিপিআইএম কোনও চাঁদা নেয় নি।

৬ই মার্চের মধ্যে স্টেট ব্যাংক তথ্য দেওয়ার পরিবর্তে, ৪ঠা মার্চ সর্ব্বোচ আদালতের কাছে ৩০ সে জুন পর্য্যন্ত সময় চেয়েছে। জানিয়েছে এই তথ্য এতো কম সময়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভাবলে অবাক লাগে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে যেখানে হারিয়ে যাওয়া তথ্য খুঁজে বের করা যায় একটি মাউস ক্লিকে সেখানে গত ৬ বছরে কয়েকটা কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েকটা রাজনৈতিক দলের অ্যাকাউন্টে কত টাকা ট্রান্সফার হয়েছে, সেই সামান্য তথ্য দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংক ‘স্টেট ব্যাংকে’র কাছে এই মুহুর্তে তৈরি নেই !  যুক্তিটা মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয়। আইনত স্টেট ব্যাংকের মালিক দেশের সরকার। নির্বাচনী বন্ডের তথ্য নিয়ে স্টেট ব্যাংকের এই লুকোচুরি আসলে সরকার কে আড়াল করার চেষ্টা। সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। স্টেট ব্যাংক বিষয়টি ধামা চাপা না দিলে আদানি আম্বানিদের কাছ থেকে বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্যান্য রাজনৈতিক দল কতটা আর্থিক সুবিধা নিয়েছে তা জন সমক্ষে চলে আসতে পারে। জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন্দ্রের শাসক দল কোনও বিশেষ শিল্পপতির থেকে চাঁদা নিয়ে তাঁর সুবিধা মতো নীতি তৈরি করেছে কি না। স্টেট ব্যাংক নির্বাচনী বন্ডের তথ্য নিয়ে যে লুকোচুরি খেলছে সেটা বিশেষ কারো চাপে, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সেটা কে সরাসরি বোঝা না গেলেও এটা পরিষ্কার, কেন লুকোচুরি করছেন। ৩০ জুন তারিখটাই তা বলে দিচ্ছে। ততদিনে ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়ে সরকার তৈরি হয়ে যাবে। ফলে নির্বাচনে অসাংবিধানিক নির্বাচনী বন্ডের কুফল রাজনৈতিক দলগুলিকে সমস্যায় ফেলবে না। বিশেষ করে বিজেপিকে।

একটা বিষয় স্পষ্ট বর্তমান শাসক দল নির্বাচনী বন্ডের সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেছে বা করছে। বিরোধীরা এ বিষয়ে খুব একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন কমিশনও টু শব্দটি করছে না। উল্টে লোকসভা নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ ৭০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৯৫ লাখ টাকা করেছে। ফলে বন্ডের সাহায্যে বাড়তি রোজগারের রাস্তা প্রশস্ত করেছে। উপায় এখন উচ্চ আদালত। ভরসা প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় । আজ ১১ই মার্চ এই বিষয়ে আদালত অবমাননার মামলার শুনানি। তিনি যদি স্টেট ব্যাংকের আবদার মেনে নির্বাচনী বন্ডের তথ্য প্রকাশের জন্য বাড়তি সময় দিয়ে দেন - তাহলে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আর একবার সামনে চলে আসবে। বিচারক কী রায় দেবেন তিনিই জানেন। তবে দেশের জনগণের কথা ভেবে স্টেট ব্যাংক কে নির্দেশ দেওয়া উচিত ২ দিনের মধ্যে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করতে হবে। নচেৎ আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত হবে।

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
A Million Missions