উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম দফার ভোট মিটেছে গতকালই। সেই উত্তরপ্রদেশ, যা জনসংখ্যার নিরিখে দেশের বৃহত্তম রাজ্য। ভারতের প্রায় ১৩৫ কোটি মানুষের মধ্যে গড়ে প্রতি ছ’জনে এক জন এই রাজ্যের বাসিন্দা। যদি উত্তরপ্রদেশ আলাদা দেশ হত, তা হলে জনসংখ্যার বিচারে সারা বিশ্বে তার আগে থাকত মাত্র পাঁচটি দেশ। চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা এবং ব্রাজ়িল।
শুধু কি তাই? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশের। নরেন্দ্র মোদী হয়তো এ রাজ্যের নন, কিন্তু তাঁরও লোকসভা কেন্দ্র বারাণসী। কেন তিনি গুজরাত ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের এই এক ডাকে চেনা জায়গাকে নিজের নির্বাচনী তালুক হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন, সে কথা কারও অজানা নয়। সাধে কি আর বলে যে, ‘দিল্লির মসনদের রাস্তা যায় লখনউ হয়ে!’
২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে এ রাজ্যে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। মোট ৪০৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে শুধু তারাই জিতেছিল ৩১২টি। অনেকেই হয়তো ভোলেননি যে, সেই জয় এসেছিল নোটবন্দির মাস কয়েকের মধ্যে। তখন বলা হয়েছিল, নোট নাকচের আসল লক্ষ্য ধনীরা, বিশেষত যাঁদের ঘরে কালো টাকার পাহাড়। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওই পদক্ষেপের জেরে কাজ গেল বহু গরিব শ্রমিকের। ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল অনেক ছোট শিল্পের। এখন অবশ্য ‘বড়লোকদের’ শায়েস্তা করতে নোটবন্দির সাফল্যের দাবি তেমন একটা বলা হয় না।
তা সে যা-ই হোক, গতবার বিজেপির জয়ে আসনের একটি বড় অংশ এসেছিল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে। যেখানে প্রথম দফার নির্বাচন হয়ে গেল ১০ তারিখ, বৃহস্পতিবার। বিজেপির নিজেদের লোকেরাই মানছেন, এই পশ্চিমাঞ্চলে তারা এ বার বেশ দুর্বল হয়ে যাবে। আসন কমার সমূহ সম্ভাবনা। কেন? এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে—
প্রথমত, চাষিদের এক বছর নাছোড় আন্দোলনের পরে তিন বিতর্কিত কৃষি আইন ফেরাতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। যাঁরা ওই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে এই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষক। ফলে ব্যালট বাক্সে তাঁদের রাগ উগরে দেওয়ার সম্ভাবনা। আর প্রবল ক্ষোভ দানা বাঁধার খবর ছিল বলেই না আইন ফেরানোর জন্য চাপ এসেছিল খোদ সঙ্ঘ পরিবারের ভিতর থেকে। আশঙ্কা ছিল, তা না করলে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে আরও দুর্বল হয়ে যাবে বিজেপি।
দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরে মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ বেঁধেছিল জাঠ ও মুসলিমদের মধ্যে। ধর্মীয় মেরুকরণে তার ফায়দা তুলেছিল বিজেপি। কিন্তু জাঠ ও মুসলিমদের এক বড় অংশ বলছেন, ওই ভুল এ বার তাঁরা আর করবেন না। এই ভোট এককাট্টা হয়ে বিরুদ্ধে পড়লে, তা অবশ্যই বিজেপির মাথাব্যথার কারণ।
তৃতীতয়, লখিমপুর খেরির স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি সাধারণ মানুষের মন থেকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে যে কাণ্ড সেখানে ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ, যে ভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণ গিয়েছে, তাতে এখনও ক্ষোভে ফুঁসছেন অনেকে।
কিন্তু শুধু পশ্চিম উত্তরপ্রদেশই তো লখনউয়ের তখ্তের ভাগ্য ঠিক করে দেবে না। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশের মাঝখানের ভাগ অবধ (লখনউ যার মধ্যে), মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের গড় হিসাবে পরিচিত পূর্বাঞ্চলের মতো অন্যান্য অংশও। প্রশ্ন হল, পশ্চিমের বাইরে ওই সমস্ত এলাকাতেও কৃষক আন্দোলনের প্রভাব কি যথেষ্ট রকম পড়বে? অনেকের মতে, ‘হ্যাঁ’। অনেকে বলছেন, ‘না’।
যাঁরা দ্বিতীয় মতের শরিক, তাঁদের যুক্তি, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব ও তাঁর জোট এ বার বেশ শক্তিশালী। কিন্তু বাকি উত্তরপ্রদেশে বিজেপি এখনও ততটা দুর্বল নয়। এবং তার প্রধান কারণ নরেন্দ্র মোদী।
উত্তরপ্রদেশে দরিদ্র মানুষের একটা বড় অংশ মোদীকে প্রায় ‘ভগবান’ মনে করেন। তার কারণ হিসাবে প্রায়ই কেন্দ্রের নানা কল্যাণ প্রকল্পের কথা বলেন তাঁরা। যেমন, নিখরচার গ্যাস সংযোগের ‘উজ্জ্বলা যোজনা’। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প। বছরে ছ’হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে ঢোকার প্রধানমন্ত্রী কিসান যোজনা ইত্যাদি। হয়তো হাজার টাকা ছুঁইছুঁই সিলিন্ডার কেনা আর সম্ভব হচ্ছে না। আবাস যোজনার টাকা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে পঞ্চায়েত প্রধানকে। তবু মোদী সরকার যে প্রকল্পগুলির সুবিধা দিয়েছে, তাতেই অনেকে যথেষ্ট খুশি।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসতে দেখা গিয়েছে। অক্সিজেন পাননি অনেকে। অনেকের বরাতে জোটেনি হাসপাতালের শয্যাও। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর প্রভাব শহুরে মধ্যবিত্তের ভোটে যতটা দেখা যাবে, গ্রামে সম্ভবত তার ছিটেফোঁটাও নয়। বিজেপির পক্ষে তা অবশ্যই সুসংবাদ।
এর সঙ্গে রয়েছে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সমীকরণ। কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির মধ্যে এ বার একটা গোপন, অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছে। কোথাও কারও শক্ত ঘাঁটিতে প্রতিপক্ষ হিসেবে দ্বিতীয় দলটি তেমন শক্তিশালী প্রার্থী দেবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে মায়াবতী এবং তার দল বহজন সমাজ পার্টি বিজেপির বিষয়ে কার্যত মৌন। যাকে বলে ‘খামোশ’। আর রয়েছেন আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। এঁদের কাটা ভোটে বিজেপির ফায়দা হবে নিশ্চিত ভাবে। তা ছাড়া, ২০১৭ সালের তুলনায় যদি এ বার ১০০টি আসনও কমে যায়, তবু সরকার গড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপির থাকবে।
যদিও ‘শ্মশান বনাম কবরস্থান’-এর মতো ধর্মীয় মেরুকরণের স্লোগান এ বার কতটা কাজে দেবে, সে বিষয়ে সন্দিহান বিজেপির নেতা-কর্মীদের অনেকে। বরং বেকারত্বের চড়া হার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আগুনে দাম, সেঞ্চুরি হাঁকানো জ্বালানির দর ইত্যাদির প্রতিফলন ব্যালট-বাক্সে দেখা যেতে পারে বলে |
শেষমেশ কী হবে, তা জানা যাবে ১০ মার্চ। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে, উত্তরপ্রদেশের ভোট নিয়ে এ বার নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলের চিন্তা রয়েছে যথেষ্ট। অন্তত লোকসভা ও রাজ্যসভায় মোদীর দীর্ঘ বক্তৃতা এবং সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে সাম্প্রতিক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার তেমনই ইঙ্গিত দেয়। হয়তো মোদীও বুঝেছেন যে, এ বার লখনউ ‘দখল’ তত সহজ হবে না। তুল্যমূল্য লড়াই হবে। যাকে বলে ‘কাঁটে কা টক্কর’।