একটি পরিবার ও একটি দেশের সর্বনাশ

কলম্বোর বাজারে ফল, আনাজের দাম দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। মাত্র কিছু দিনের মধ্যে। চাল দেড় গুণ। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ নেই। রাস্তায় স্তূপীকৃত জঞ্জাল। কারণ, তা তুলতে আসার মতো জ্বালানিটুকুও পৌরসভার গাড়িতে নেই! শিকেয় উঠেছে পড়াশোনা। পরীক্ষা দিতে পারছে না স্কুলের ছেলেমেয়েরা। দেবে কী করে? কাগজ আমদানির পয়সাই তো শ্রীলঙ্কা সরকারের নেই! তাই বই-খাতা নেই, ছাপাখানাও বন্ধ। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পাওয়ার আশায় অনেকে সব ছেড়েছুড়ে ওই প্রতিবেশী দেশ থেকে চলে আসতে চাইছেন ভারতে। অভূতপূর্ব সঙ্কটে দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতি।
শ্রীলঙ্কা বলতেই চোখের সামনে সমুদ্রতটের স্বর্গীয় সৌন্দর্য চোখে ভাসে। স্মৃতিতে এখনও অমলিন ক্রিকেটে তাদের বিশ্বজয়। সেই দেশের এমন চরম দুর্দশা কেন? বিশেষত তারা যেখানে সেই সত্তরের দশক থেকে আর্থিক উদারিকরণের পথে হেঁটেছে!
কারণ অনেক। তবে তার অন্যতম এবং সম্ভবত প্রধান কারণ, একটি পরিবারের ‘তানাশাহি’। সহজ কথায়, দেশকে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করে খামখেয়ালি একনায়কতন্ত্র।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দাদা মহিন্দা রাজপক্ষে (যিনি আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন)। এঁদের ছোট ভাই এবং মহিন্দার ছেলেও ক্ষমতায়। শ্রীলঙ্কার এই মুহূর্তে যা অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি, যে ভাবে বিক্ষোভে উত্তাল সাধারণ মানুষ, যে ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করেও তা ফিরিয়ে নিতে হয়েছে, তাতে হয়তো আর বেশি দিন এই পরিবারের পক্ষে মসনদ আঁকড়ে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি এই পরিবার করে দিয়ে যাচ্ছে, আগামী বহু দিনেও তা পূরণ হওয়া শক্ত।
কেন এমন মুখ থুবড়ে পড়ল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি?
দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি বরাবরই বিদেশি পর্যটকের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। ওই সূত্রে আসা বিদেশি মুদ্রা এবং পর্যটন শিল্পে তৈরি হওয়া কাজের সুযোগই এ দেশের অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। সেই সঙ্গে ভরসা চা আর রাবার রফতানি। কিন্তু এই সমস্ত কিছুই একের পর এক ঘটনা আর খারাপ সিদ্ধান্তে তছনছ!
কী ভাবে?
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল বোমা বিস্ফোরণ হল তিন গির্জা ও তিন হোটেলে। সরকারি ভাবেই মৃত ২৬৯ জন। ৫০০ জনের বেশি আহত। এঁদের মধ্যে ৪৫ জন আবার বিদেশি। সেই থেকে পশ্চিমি দুনিয়ার পর্যটক কমে গেল শ্রীলঙ্কায়। যেটুকু ছিল, কোভিডে তা-ও শেষ।
২০১৯ সালে ভোটের আগে এই রাজাপক্ষে পরিবারের তরফে প্রতিশ্রুতি ছিল, ধাপে ধাপে দশ বছরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করে দেবে তারা। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হল কার্যত রাতারাতি। ধান উৎপাদন কমে গেল। জোর ধাক্কা খেল রাবার, চা ইত্যাদির উৎপাদনও। কাজ গেল বহু জনের।  সরকার পরে বুঝল, ভুল হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের মতোই জামাকাপড় তৈরিতে নামডাক হয়েছিল শ্রীলঙ্কার। বিশ্ব বাজারে পড়তি চাহিদা আর দেশে একের পর এক ‌খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে তারও দফারফা।
এমনিতেই শ্রীলঙ্কা আজ বহু দশক আদ্যন্ত পুঁজিবাদে বিশ্বাসী। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কের থেকে ধার তার নতুন নয়। তার উপরে অর্থনীতির হাল যত খারাপ হতে শুরু করল, তত বাড়তে শুরু করল বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক। পুরনো ধারের সুদ শোধ করতেই নেওয়া শুরু হল নতুন ঋণ। এ ভাবেই ঋণের জালে জড়িয়ে গেল শ্রীলঙ্কা। যাকে বলে ‘ডেট ট্র্যাপ’।
কিন্তু যে পরিবারের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত দেশকে এমন পথে বসাল, তার উপরে ভোট-বাক্সে শ্রীলঙ্কাবাসী অমন অগাধ আস্থা দেখালেন কী করে? আসলে এলটিটিই-র সর্বাধিনায়ক ভেলুপিল্লাই প্রভাকরনকে মেরে দ্বীপরাষ্ট্রকে শান্ত করার পরে ‘শক্তিশালী শাসক’ হিসেবে অঢেল আস্থা তৈরি হয়েছিল রাজাপক্ষেদের উপরে। অনেকে মনে করেছিলেন, তামিল সন্ত্রাসবাদীদের যদি ঠান্ডা করা যায়, তা হলে মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের (গির্জা বিস্ফোরণে যারা অভিযুক্ত) জব্দ করার ক্ষেত্রেও রাজাপক্ষেরাই উপযুক্ত। অথচ এই পরিবারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, সাংবাদিক হত্যা...তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু ও-ই কঠোর শক্তিশালী শাসকের ভাবমূর্তিতেই মজেছিলেন দ্বীপরাষ্ট্রের অনেকে।
কিন্তু ব্যালট বাক্সে ভুল বাছাই এবং সেই সূত্রে এক পরিবারের খামখেয়ালি ‘তানাশাহি’ একটি দেশকে কোন খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে পারে, রাজাপক্ষে এবং শ্রীলঙ্কা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

Featured Book: As Author
Divided We Stand
India in a Time of Coalitions
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Gas Wars
Crony Capitalism and the Ambanis
Also available: