আজ বাংলা কী ভাবছে?

পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনের প্রভাব শুধু এই রাজ্যের রাজনীতিতেই প্রভাব ফেলবে এমন নয়, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতও নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ওপর। যদি এই নির্বাচনে বিজেপি জেতে, তাহলে মোদী-শাহের নেতৃত্বাধীন বিজেপি অশ্বমেধের ঘোড়ার মতোই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে বিজেপি যে বিরোধী-মুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখে, সেই বিরোধী-মুক্ত ভারতের রূপটি পূর্ণতা পাবে এই বাংলায়। এই পরিস্থিতিকে আমরা নিঃসঙ্কোচে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে অভিহিত করতে পারি।

নির্বাচনী ফলাফলে বিজেপি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় এবং সরকার গঠন করতে না পারে, তাহলেও তারা তাদের আসন সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়াতে পারবে এবং সেটাকেই তারা তাদের ‘জয়’ বলে উল্লেখ করবে। তার মানে কি ভোটের ফল যাই হোক না কেন, বিজেপি-র লাভই লাভ? না, তা নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বাংলায় 5 বছরের জন্য একটা অ-বিজেপি সরকার গঠিত হলে (তৃণমূলের একার জোরে কিংবা অন্যদের সাহায্যে) মোদীর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খায় লাগাম পড়বে এবং কিছু সময়ের জন্য হলেও বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানকে রুখে দেওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণপন্থী দল বা সংগঠনগুলির বিরুদ্ধাচারণ যাঁরা করছেন, তাঁদের জন্যও এটা আশাব্যঞ্জক হবে।

গত সাত বছরে, বিশেষত 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে, মানুষ লোকসভা নির্বাচনে যে দলকে ভোট দেন, বিধানসভা নির্বাচনে সেই দলকে ভোট দেন না। সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর সমাজ বিজ্ঞানী অভয় দুবে একে রাজনীতির ‘সরকারিকরণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এতে কেন্দ্র কিংবা রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসকদল নির্বাচনে সুবিধা পায়। এই কারণেই বিজেপির কাছে বাংলা এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। বিজেপি নেতৃত্ব জানে, গত লোকসভায় তারা 42টি আসনের মধ্যে 18টি আসন পেয়ে যে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো যথেষ্ট সমস্যার। প্রসঙ্গত দু'বছর আগের সেই নির্বাচনে বিজেপি বাংলায় মোটের ওপর 40 শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

অনেক প্রশ্নের উত্তর তখনই পাওয়া যাবে, যখন এই ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবে। যেমন, তৃণমূল-বিরোধী ভোটটা কোথায় যাবে? এই ভোটটা বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় কি শাসকদল তৃণমূলের সুবিধা হয়ে যাবে? নাকি, বিজেপি বিরোধী ভোটটা বিশেষত সংখ্যালঘু ভোটটা ভাগ হয়ে গিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেবে? ভোটের আগে এসব নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হিসাব কষাকষি চললেও, কোনও ভোট-বিশেষজ্ঞ সাহস করে বলতে পারছেন না যে, এবারের ভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, না একপেশে লড়াই হবে?

সম্প্রতি আমি এই বিষয়ে তিনজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁদের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এখানে তুলে দেওয়া হল, কারণ তাঁদের বক্তব্যের অনেক কিছুর সঙ্গেই আমি সহমত পোষণ করি৷ রাজনীতি বিশারদ সুভাষ পালসিকরের মতে, বাংলার নির্বাচন এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, তা নির্ধারিত করে দেবে বিজেপি তার সংকীর্ণ রাষ্ট্রবাদী ভাবধারাকে আরও সম্প্রসারিত করতে এবং নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের মডেল আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা। বিজেপি-র ভাবনায় তাদের নির্বাচিত সুপ্রিম নেতার বিরোধিতা করা মানেই দেশদ্রোহিতা।

ঔপনিবেশিক দেশদ্রোহিতা বিরোধী আইনের ব্যবহার বিজেপি-র আমলে বহুগুণ বেড়েছে। ‘আর্টিকেল 14’ নামক ওয়েবসাইটের সমীক্ষা অনুসারে, গত 10 বছরে যে 405 জন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরকারকে সমালোচনা করার দায়ে এই সিডিশন আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে তার 96 শতাংশই হয়েছে মোদী ক্ষমতায় আসার পর। ঘটনাচক্রে এই অভিযোগগুলো নথিভুক্ত হয়েছে 2014 সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর। দেশদ্রোহিতামূলক মামলা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো এই ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে 149 জন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানিকর মন্তব্য করার দায়ে দেশদ্রোহিতামূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। 144 জনের বিরুদ্ধেও একইভাবে মামলা করা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করার জন্য।

লেখক, সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষ বাংলার বিধানসভা নির্বাচনকে পলাশীর যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। এক্ষেত্রে ক্লাইভ সাফল্য পেয়েছিলেন, কারণ তিনি শুধু দক্ষ সামরিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন কৌশলী, যিনি নবাবের সেনাপতি মীরজাফরকে নিজেদের পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিজেপিও একইভাবে তৃণমূলের অন্যতম সৈনিক শুভেন্দু অধিকারীকে নিজেদের শিবিরে নিয়ে এসেছে। অনেকেই সাগরিকার এই উপমাকে অতিরঞ্জন বলছেন। কিন্তু যাঁরা সাগরিকার সঙ্গে এই ব্যাপারে একমত হচ্ছেন না, তাঁরাও বলছেন বাংলার এই নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে একটা বিশাল প্রভাব রাখতে চলেছে এবং এই প্রভাব এই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশীষ নন্দীর মতে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক লড়াই লড়ছেন, যিনি 130 কোটি ভারতবাসীর ‘ভাগ্যবিধাতা’। আশীষ নন্দী এবং অন্যরা বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন তুলছেন। ভোটদাতারা রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের শুধু ভাল খারাপ বা সাদা কালোর বাইনারিতেই বিভক্ত করেন? নাকি কোনটা ছোট আপদ এবং কোনটা বড় বিপদ এই বাইনারিতেও ভাঙেন? এবং তার মধ্যে প্রথমটাকে বেছে নেন? সেক্ষেত্রে আশীষ নন্দীর প্রশ্ন, এইরকম ধারণার বশবর্তী হয়েই কি ভোটদাতারা মোদী বনাম মমতার লড়াই ভেবে এই নির্বাচনে ভোট দেবেন?

মোদী আসার পর ভারতবর্ষের বহুদলীয় গণতন্ত্র আমেরিকার মতো দুই ব্যক্তির রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। বিজেপির তরফে বারংবার রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে প্রমাণ করা হয়েছে, তিনিই মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বী। বিজেপি এককভাবে 2014-র লোকসভার তুলনায় 2019-এর লোকসভায় প্রায় 6 শতাংশ ভোট বাড়িয়েছে (31.3 শতাংশ থেকে 37.4 শতাংশ)। জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা বা NDA-র ভোট শতাংশও 5 বছরের ব্যবধানে 37 শতাংশ থেকে বেড়ে 45 শতাংশ হয়েছে। তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিজেপি এবং তার জোটসঙ্গীদের ভোট দেয়নি।

এখন তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিরই রমরমা। একদিকে মোদী তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় তাঁর দলের থেকেও বড়। অন্যদিকে মমতা তো আস্ত তৃণমূল কংগ্রেস দলটাই। দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের লড়াইটাই বাংলায় এখন বৃহত্তর রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। মমতা তাঁর আবেগঘন ভঙ্গিতে সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলাদের তাঁর অনুকূলে আনার চেষ্টা করছেন। ভোটের পর বাংলায়, মহারাষ্ট্রের মতো দু'টি পরস্পর বিরোধী দলের জোট দেখা গেলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। এখানে ফারাক বলতে একটাই, মহারাষ্ট্রে তবু বিজেপির একদা জোটসঙ্গী শিবসেনা ছিল, বাংলায় কিন্তু এখনও অবধি বিজেপির তেমন কোনও জোটসঙ্গী নেই।

বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে যাঁরা স্বতন্ত্র দেখাতে চান, তাঁরা গোপালকৃষ্ণ গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তির— ‘আজ বাংলা যা ভাবে, বাকি ভারত তা আগামীকাল ভাবে’— কথা উল্লেখ করেন। মহাত্মা গান্ধী, মহম্মদ আলি জিন্না উভয়েই নরমপন্থী কংগ্রেসি নেতা গোখলেকে তাঁদের রাজনৈতিক গুরু বলে মানতেন। 1915 সালে মাত্র 48 বছর বয়সে তিনি মারা যান। কলকাতা থেকে দিল্লিতে দেশের রাজধানী স্থানান্তর, রক্তক্ষয়ী দেশভাগ, শিল্পক্ষেত্রে ক্রমিক অবক্ষয় বাংলাকে সবদিক থেকে অধোগতির দিকে নিয়ে গেছে। একটা শতক পর এই নির্বাচনে গোখলে কি তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তির জন্য আরও একবার ঠিক বা ভুল বলে প্রমাণিত হবেন?

এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি কি 2 মে-তে ভোটের ফলপ্রকাশের সঙ্গেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে? নাকি রাজ্যে আট দফার প্রলম্বিত নির্বাচনের মতোই এই উত্তর পেতে আমাদের অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে?

Featured Book: As Author
The Real Face of Facebook in India
How Social Media Have Become a Weapon and Dissemninator of Disinformation and Falsehood
  • Authorship: Cyril Sam and Paranjoy Guha Thakurta
  • Publisher: Paranjoy Guha Thakurta
  • 214 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Chasing His Father's Dreams
Inside Story of Odisha's Longest Serving Chief Minister