Hindenburg 2.0: আরও কোনঠাসা আদনি! মোদির ছত্রছায়ায় শেষরক্ষা হবে?

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের পর অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (OCCRP)। আবারও আর্থিক তছরুপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থা কাঠগড়ায় তুলল শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর সংস্থা আদানি গোষ্ঠীকে। শেয়ারদরে কারচুপি থেকে প্রতারণা, বিনিয়োগ আইন লঙ্ঘনের মতো ভুরি ভুরি অভিযোগ নরেন্দ্র মোদি ঘনিষ্ঠ আদানিদের বিরুদ্ধে। আর্থিক তছরুপ নিয়ে তদন্তকারী সাংবাদিকদের নিয়ে তৈরি ওই সংস্থার রিপোর্ট ঘিরে নতুন করে উত্তাল পরিস্থিতি। তদন্ত রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে অভিযুক্তপক্ষ সাফাই দেওয়ার সুযোগ পায়।  OCCRP-র তরফেও আদানি গোষ্ঠী এবং ভারতীয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা SEBI-কে সুদীর্ঘ প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল। আর তা হাতে পাওয়া মাত্রই শুরু হয় ধনকুবেরের হয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা।

আমেরিকার শর্ট সেলিং সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের ৩২ হাজার শব্দের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি। তাতে শেয়ারের দরে কারচুপি থেকে জালিয়াতির ভুরি ভুরি অভিযোগ ছিল তাতে। কর্পোরেট জগতের ইতিহাসে এত বড় জালিয়াতি, জোচ্চুরি আগে কখনও হয়নি বলেই স্পষ্ট জানিয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। সেই রিপোর্ট সামনে আসতেই বিশ্বের তদানীন্তন তৃতীয় ধনকুবের এবং তাঁর সংস্থা শেয়ার বাজারে মুখ থুবড়ে পড়ে। আদানি গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করা ৩ লক্ষ কোটি টাকা রাতারাতি গায়েব হয়ে যায় বাজার থেকে। প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে গত কয়েক মাস ধরে সেই ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করছিল আদানি গোষ্ঠী। তার মধ্যেই প্রকাশ্যে এল OCCRP-র রিপোর্ট, আবারও মারাত্মক সব অভিযোগ। OCCRP-র রিপোর্টকে তাই হিন্ডেনবার্গ ২.০ বলেও উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। অনেকেই বলছেন, আগামী দিনগুলি আদানি গোষ্ঠীর জন্য খুব একটা সুখকর হবে না।

কারণ আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গড়েছে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তরফে ‘সম্ভাব্য ব্যর্থতা’ ছিল বলে ইতিমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ওই সংস্থা। ‘মিনিমাম পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং’, ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেন’, ‘সুবিধাভোগী মালিকানা’র মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে হেঁয়ালি করা হয়েছে বলেও দাবি ওই কমিটির। সহজ ভাষায় প্রযুক্তিগত দিকগুলি ব্যাখা করতে বলা হলেও, তা নিয়ে ওই কমিটির সঙ্গে একমত হওয়া তো দূর, বরং নানা অছিলায় শুধু বাড়তি সময় চেয়ে গিয়েছে SEBI। তদন্তপ্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল, জাতীয় স্তরে এক্তিয়ারগত সমস্যা রয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টে টালাবহানাও করতে দেখা যায় তাদের। সেই গড়িমসির মধ্যেই হিন্ডেনবার্গ ২.০ পর্বের আবির্ভাব।

হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট যেভাবে খারিজ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল সব স্তর থেকেই, এবারও OCCRP-এর গুরুত্ব খর্বের চেষ্টা চলেছে পুরোদমে।  বর্তমান ভারত সরকারের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক যাঁর, সেই জর্জ সোরোসেরের সংস্থা OCCRP-কে অর্থসাহায্য দেয়। এবং ভারতকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চলানো হচ্ছে বলে অমূলক অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গৌতম আদানিকে সরাসরি ‘মোদি-ঘনিষ্ঠ’ বলে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি। বলা হয়েছে, তিন এবং চারের দশকে আমেরিকার সরকার যেমন ফোর্ড, রকফেলার্স, লেম্যান ব্রাদার্স এবং ভ্যান্ডারবিল্টসদের মতো বড় বড় শিল্পপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশে পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, মোদি-আদানির সম্পর্ককেও সেই গোত্রেই ফেলা হয়। কিন্তু পত্রপাঠ এইসব অভিযোগ খারিজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে শাসকদল বিজেপি এবং আদানির মদতপুষ্ট ট্রোলিং সেনা। কারণ OCCRP-র তদন্ত-রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে আনন্দ ম্যাঙ্গনেল, রবি নায়ার এবং এনবিআর আরকেডিও-র মতো সাংবাদিকতার জগতের প্রতিষ্ঠিত কর্তা-ব্যক্তিদের হাতে। ব্রিটেনের দুই খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যম, দ্য গার্ডিয়ান এবং দ্য ফাইনান্সিয়াল টাইমস সেই রিপোর্ট সামনে নিয়ে আসে, যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ওই সমস্ত খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমকে জর্জ সোরোস এবং তাঁর ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের পদলেহনকারী বলে তড়িঘড়ি দাগিয়ে দেওয়া যায়নি।

এর বাইরে আরও একটি বিষয় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ যে, তদন্তে নেমে যে সমস্ত ফাঁকফোকরগুলি ঢাকা যাচ্ছে না বলে এ যাবৎ দাবি করে এসেছে SEBI, সেই সব ফাঁকফোকরগুলির মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনই করেনি OCCRP, একাধিক জায়গায় খামতিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তারা। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের নেথান অ্যান্ডারসন আদতে মেনে নিয়েছেন, যে জায়গা গুলি বাদ পড়ে গিয়েছিল, যেখানে যেখানে হিসেব মেলানো যাচ্ছিল না, তা দুয়ে দুয়ে চার করে দিয়েছে OCCRP-র রিপোর্ট।

OCCRP-র রিপোর্টে উঠে এসেছে তাইওয়ানে বসবাসকারী জনৈক চাং চুং-লিং, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বাসিন্দা নাসের আলি শাবান আলির নাম। ওই দু’জনের সঙ্গে গৌতম আদানির সাইপ্রাস নিবাসী দাদা বিনোদ আদানির সংযোগ উঠে এসেছে। ওই দুই ব্যক্তিই বিনোদ আদানির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সহযোগী।

আদানি গোষ্ঠী থেকে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিপত্র, ইমেল, মেসেজ তুলে এনে হিসেব মিলিয়ে দিয়েছে OCCRP। বারমুডা এবং মরিশাসের মতো করফাঁকির স্বর্গরাজ্যে কী ভাবে হাওয়ালার মাধ্যমে প্রথমে টাকা পাচার করা হয় এবং ঘুরপথে কোন উপায়ে সেই টাকা আবার আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে ঢোকে, যার সাহায্যে শেয়ার দরে হেরফের ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল আদানি গোষ্ঠী, তার বিশদ বর্ণনা মিলেছে OCCRP-র রিপোর্টে। হেঁয়ালি করে যাঁদের ‘সংশ্লিষ্ট পক্ষ’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছিল, তাঁদের হাত দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ লেনদেন হয়েছে বলে উঠে এসেছে রিপোর্টে। দেখা গিয়েছে, সাধারণ মানুষের জন্য নূন্যতম ২৫ শতাংশ শেয়ার রাখার যে বিধি রয়েছে, তা লঙ্ঘন করে আদানি-ঘনিষ্ঠরাই আদানিদের শেয়ারে বিনিয়োগ করে এসেছে। অর্থাৎ ৭৫ শতাংশের বেশি শেয়ার নিজেদের হাতে রেখে, নিজেরাই শেয়ারের দরে হেরফের ঘটিয়ে আসছিল আদানিগোষ্ঠী।

সাংবাদিকরা যদি দুর্নীতির আঁতুরঘরে পৌঁছতে পারেন, এত বছর ধরে তাহলে কী করছিল SEBI? স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে প্রশ্ন। আরও একটি বিষয় আদানিগোষ্ঠীর হৃদস্পন্দন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।  OCCRP-র রিপোর্টে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনস্ত রাজস্ব বিভাগের তদন্তকারী আধিকারিকের একটি চিঠির উল্লেখ রয়েছে। মোদি ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস আগে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ওই চিঠির মাধ্যমে SEBI-কে সতর্ক করা হয়েছিল। খরচ-খরচা বেশি দেখিয়ে ভারত থেকে বাইরে টাকা নিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেই টাকাই ফের ঘুরপথে ভারতের শেয়ার বাজারে ঢালা হচ্ছে, শেয়ার বাজারকে কৃত্রিম উপায়ে প্রভাবিত করা হচ্ছে বলে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল SEBI-কে। সেই সময় SEBI-র প্রধান ছিলেন ইউকে সিনহা। আদানি গোষ্ঠী সম্প্রতি খবরের চ্যানেল NDTV কিনে নেওয়ার পর, ওই ইউকে সিনহাকেই NDTV-র বোর্ডের ডিরেক্টর নিযুক্ত করা হয়। ওই চিঠি এড়িয়ে, তদন্ত নিয়ে উচ্চবাচ্য না করে, ইউকে সিনহা আদানি গোষ্ঠীর উপকার করেছেন বলেই পুরস্কার স্বরূপ তাঁকে NDTV-র বোর্ডের ডিরেক্টর করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীও সাংবাদিক বৈঠক করে সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত হোক বলেও দাবি তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।  

শেয়ার কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগ সামনে আনায়, এ বছরের গোড়াতেই হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। তার পর ছ’মাসেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। এখনও হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপের দিকে এগোয়নি আদানি গোষ্ঠী। বরং নিজের লেখা প্রতিবেদন তুলে ধরে ট্যুইটারে (অধুনা X) লেখা পোস্ট করার জন্য সাংবাদিক রবি নায়ার এবং আরও বেশ কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গুজরাতের একটি আদালতে মামলা করা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু মামলা আবার তুলেও নিয়েছেন আদানি গোষ্ঠীর আইনজীবীরা। এই প্রতিবেদকের বিরুদ্ধেও বর্তমানে ছ’টি মানহানির মামলা ঝুলছে। গুজরাত এবং রাজস্থানের বিভিন্ন আদালতে দায়ের হয়েছে সেগুলি।

একের পর এক মারাত্মক অভিযোগে বিদ্ধ হয়ে আদানি গোষ্ঠীর তরফে ছয় অনুচ্ছেদের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। আর তাতে বেশ আক্রমণাত্মক ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছে তাদের। রিপোর্ট অসম্পূর্ণ, পুরনো অভিযোগকেই মশলা মাখিয়ে পেশ করা হচ্ছে এমন অভিযোগের পাশাপাশি তাদের দাবি, জর্জ সোরোসের মদতে সারবত্তাহীন হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টকেই পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চলছে। তবে এর পাশাপাশি একথাও সত্য যে, OCCRP-র রিপোর্টে উঠে আসা একটি অভিযোগও অস্বীকার বা খারিজ করে দেয়নি আদানি গোষ্ঠী। তার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ এবং তেরঙ্গা নিয়ে আবেগকে সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টাই করেছেন গৌতম আদানি। জি-২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে তাঁকে এবং তাঁর দাদাকে নিশানা করে আসলে ভারতকেই খাটো করে দেখানো হচ্ছে বলে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন তিনি। নিজের অপকর্ম থেকে যে কোনও প্রকারে নজর ঘোরাতে চাইছেন। কিন্তু মোদি-আদানি সখ্য চাপা নেই কারওর কাছেই। তাই আদানি কিছুই করেননি বলে মানুষকে বিশ্বাস করানো এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বেশ কঠিন। এখনও SEBI-র উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে যদিও। তদন্তে তাদের হাতে তথ্য উঠে আসা বা না আসা, তাই দু’টোই বেশ গুরুত্বপূর্ণ এখন। কিন্তু তদন্তরিপোর্ট যাই হোক না কেন,  শেষ পর্যন্ত বল কিন্তু গিয়ে পড়বে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের কোর্টেই। তাই সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কী অবস্থান নিচ্ছে, কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ব্যাপারটিকে, তার উপরেই নির্ভর করছে গোটা খেলা। 

Featured Book: As Author
The Real Face of Facebook in India
How Social Media Have Become a Weapon and Dissemninator of Disinformation and Falsehood
  • Authorship: Cyril Sam and Paranjoy Guha Thakurta
  • Publisher: Paranjoy Guha Thakurta
  • 214 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon
 
Featured Book: As Publisher
The Queen of All Nations